২২জুন, ২০২২, ০০:০০
এক খ্রিষ্টান বন্ধু আমাকে প্রশ্ন করল : তুমি কি একজন ৫০ বছর বয়স্ক লোকের সাথে তোমার সাত বছরের কন্যাকে বিয়ে দেবে? আমি তৎক্ষণাত এর কোনো উত্তর না দিয়ে নীরব থাকলাম। বন্ধুটি বলল, যদি তা সমর্থন না করো, তাহলে তোমরা তোমাদের নবী সা:-এর সাথে কিভাবে সাত বছরের নিষ্পাপ নিরপরাধ আয়েশার রা:-এর বিয়েকে মেনে নাও?
আমি তাকে বললাম : আমার কাছে এ মুহূর্তে এর কোনো উত্তর নেই। বন্ধুটি হেসে আমার বিশ্বাসের মূলে নিরন্তর জ্বালা সৃষ্টি করে চলে গেল। আমি জানি, অধিকাংশ মুসলমান এ প্রশ্নের উত্তর দেবে এই বলে যে, এ ধরনের বিয়ে তখনকার সময়ে গ্রহণযোগ্য ছিল। তা না হলে জনগণ নবীর সাথে আয়েশার বিয়েকে মেনে নিত না, বিরোধিতা করত।
আসলে এ ধরনের ব্যাখ্যা মূলত সহজ-সরল অর্বাচীন লোকের সাথে এক ধরনের প্রতারণার শামিল, যারা তা অন্ধের মতো বিশ্বাস করে। আমার মন সন্তুষ্টচিত্তে এ উত্তর মেনে নিতে অস্বীকার করে।
নবী মুহাম্মদ সা: হলেন অনুকরণীয় চরিত্র। তাঁর সব কাজ পূত-পবিত্র। আমরা মুসলমানরা তাই তাঁর সব কাজ অনুসরণ করার চেষ্টা করি। তা সত্ত্বেও যুক্তরাষ্ট্রে বসবাসরত কোনো লোক চিন্তা করে না যে, সে তার সাত বছরের কন্যাকে একজন ৫০ বছরের বয়স্ক লোকের সাথে বাগদান করবে। যদি কোনো পিতা এ রকম বিয়েতে রাজি হয়, তাহলে বেশির ভাগ লোক স্বাভাবিকভাবেই এ কন্যার পিতাকে ঘৃণার চোখে দেখবে।
১৯২৩ সালে মিসরে ম্যারেজ রেজিস্ট্রারদের নির্দেশ দেয়া হয়, কনেদের ক্ষেত্রে ১৬ বছরের কম হলে এবং বরদের ক্ষেত্রে ১৮ বছরের কম হলে বিয়ে রেজিস্ট্রি না করার জন্য এবং একই সাথে আদেশ দেয়া হয় আনুষ্ঠানিক বিয়ের কোনো সনদপত্র না দেয়ার জন্য। এর আট বছর পর, ১৯৩১ সালে শরিয়াহ আদালত কনেদের ক্ষেত্রে ১৬ বছরের কম এবং বরদের ক্ষেত্রে ১৮ বছরের কম বিয়ে সংক্রান্ত শুনানি করতে অস্বীকার করার মাধ্যমে এ আইনকে আরো সংহত ও শক্তিশালী করে।
এটাই প্রমাণ করে যে, মিসরের মতো একটি মুসলিম সংখ্যাগরিষ্ঠ দেশেও বাল্যবিয়ে গ্রহণযোগ্য নয়। নির্ভরযোগ্য সাক্ষ্য প্রমাণ ব্যতিরেকে সাত বছরের আয়েশার সাথে ৫০ বছর বয়স্ক নবীর বিয়ের কাহিনী নিছকই অলিক কল্পকাহিনী বৈ কিছু নয়। এ বিষয়ে সত্য উদঘাটন করার জন্য দীর্ঘ অনুসন্ধিৎসা আমার ধারণাকেই সঠিক বলে প্রমাণ করে। নবী হলেন একজন সজ্জন অমায়িক ব্যক্তি। তাই তিনি সাত-নয় বছর বয়সের একজন নিষ্পাপ বালিকাকে বিয়ে করেননি। হাদিস গ্রন্থে আয়েশার বয়স ভুলভাবে লিপিবদ্ধ হয়েছে। আমার দৃষ্টিতে বিয়ের বয়স নিয়ে যে ঘটনা বর্ণনা করা হয়েছে তা বিশ্বাসযোগ্য নয়। নবীর সাথে আয়েশার বিয়ের সময়কার বয়স সম্পর্কিত কিছু কিছু হাদিস ত্রুটিপূর্ণ। এ পর্যায়ে আমি হিশাম ইবনে উরওয়াহ কর্তৃক বর্ণিত অলিক কাহিনীর বিষয়ে কিছু সাক্ষ্য-প্রমাণ উপস্থাপন করব। নবী একজন নিষ্পাপ বালিকাকে তার যৌন লালসার শিকারে পরিণত করেননি (নাউজুবিল্লাহ)। বরং দায়িত্বপূর্ণ বয়স্ক প্রাজ্ঞ ব্যক্তি হিসেবে আচরণ করেছেন। তার বিরুদ্ধে আনীত অমূলক অভিযোগের অপনোদন করাই এ প্রবন্ধের লক্ষ্য।
প্রমাণ ১: সাক্ষ্য প্রমাণের গ্রহণযোগ্যতা
নবীর সাথে আয়েশার বিয়ের সময়কার বয়স সম্পর্কিত যেসব বর্ণনা হাদিস গ্রন্থসমূহে উল্লেখিত হয়েছে, তার বেশির ভাগ বর্ণনাই করেছেন হিশাম ইবনে উরওয়াহ। তিনি তার পিতার বরাতে এসব বর্ণনা করেন। প্রথমত. যৌক্তিকভাবে এটি বলা যায়, এক দুই বা তিনজনের বেশি ব্যক্তির এ ঘটনা বর্ণনা করার কথা। আশ্চর্যের বিষয় হলো মদিনার কোনো ব্যক্তি এ ঘটনা বর্ণনা করেননি। মদিনায় তার অনেক ছাত্র ছিল। তার মধ্যে বহুল পরিচিত সবার শ্রদ্ধেয় মালিক ইবনে আনাসের নাম উল্লেখযোগ্য। বরং এ বর্ণনার মূল উৎস হলো ইরাক, যেখানে জীবনের ক্রান্তিলগ্নে ৭০ বছর মদিনায় অবস্থান করার পর হিশাম চলে যান।
তেহজিবুল-তেহজিব হাদিস বর্ণনাকারীদের জীবনী গ্রন্থগুলোর মধ্যে বিশ্বাসযোগ্যতা ও নির্ভরতার জন্য সুপরিচিত প্রমাণিক গ্রন্থ। ইয়াকুব ইবনে শাইবাহর বরাতে বর্ণিত : ‘হিশাম খুবই বিশ্বাসযোগ্য আস্থাভাজন ব্যক্তি। তাঁর বর্ণনাও গ্রহণযোগ্য, তা ছাড়া যা তিনি ইরাক যাওয়ার পর বর্ণনা করেন।’
এ গ্রন্থে আরো উল্লেখিত রয়েছে, হিশামের বর্ণনা করা হাদিসের ব্যাপারে মালিক ইবনে আনাস আপত্তি উত্থাপন করেন যা ইরাকের লোকদের মাধ্যমে বর্ণিত : ‘আমাদের বলা হয়েছে যে, হিশামের বর্ণনা করা হাদিসের ব্যাপারে মালিক ইবনে আনাস আপত্তি করেছেন, যা ইরাকের লোকদের বরাতে বর্ণিত।’
হাদিস বর্ণনাকারীগণের আরেকটি জীবনীগ্রন্থ মিজানুল আল টাইডাল-এ বর্ণিত ‘বৃদ্ধ বয়সে হিশামের স্মরণশক্তি মারাত্মকভাবে লোপ পায়।’
উপরে উল্লেখিতি তথ্যের ভিত্তিতে বলা যায় যে, বয়সকালে হিশামের স্মরণশক্তি লোপ পায়। ইরাকে অবস্থানকালে যেসব হাদিস তিনি বর্ণনা করেন, তা নির্ভরযোগ্য নয়। তেমনিভাবে আয়েশার বিয়ে ও তার বয়স সম্পর্কিত হাদিসও নির্ভরযোগ্য নয়।
এ প্রসঙ্গে নিম্নে উল্লেখিত ইসলামের ইতিহাসের কিছু প্রাসঙ্গিক তারিখ আমাদের মনে রাখা অত্যাবশ্যক। সেগুলো হলোÑ ৬১০ খ্রিষ্টাব্দের পূর্বে : ইসলামপূর্ব যুগ জাহেলিয়াÑওহি নাজিলের পূর্ব পর্যন্ত, ৬১০ খ্রিষ্টাব্দ : প্রথম ওহি, ৬১০ খ্রিষ্টাব্দ : আবু বকরের ইসলাম গ্রহণ, ৬১৩ খ্রিষ্টাব্দ : নবী মুহাম্মদ সা:-এর প্রকাশ্যে ইসলাম প্রচার শুরু, ৬১৫ খ্রিষ্টাব্দ : আবিসিনিয়ায় হিজরত, ৬১৬ খ্রিষ্টাব্দ : ওমর বিন খাত্তাবের ইসলাম গ্রহণ, ৬২০ খ্রিষ্টাব্দ : সাধারণভাবে স্বীকৃত নবী ও আয়েশার বাগদানের সন, ৬২২ খ্রিষ্টাব্দ : মদিনায় হিজরত, ৬২৩/৬২৪ খ্রিষ্টাব্দ : সাধারণভাবে মনে করা হয় নবী ও আয়েশা এ সময় একত্রে বসবাস শুরু করেন।
প্রমাণ ২ : বাগদান
তাবারি, হিশাম ইবনে উরওয়াহ, ইবনে হানবাল ও ইবনে সাদের মতে, আয়েশার বিয়ে হয় সাত বছর বয়সে এবং নবীর সাথে একত্রে বসবাস শুরু করেন নয় বছর বয়সে।
অন্য গ্রন্থে তাবারি উল্লেখ করেন : ইসলামপূর্ব যুগে দুই স্ত্রীর ঔরসে আবু বকরের চার সন্তানের জন্ম হয়। আয়েশার ৬২০ খ্রিষ্টাব্দে সাত বছর বয়সে বাগদান হয় এবং নবীর সাথে একত্রে বসবাস শুরু হয় ৬২৪ খ্রিষ্টাব্দে নয় বছর বয়সে। এ থেকে প্রতীয়মান হয় আয়েশার জন্ম হয় ৬১৩ খ্রিষ্টাব্দে এবং তিনি নবীর সাথে একত্রে থাকতে শুরু করেন নয় বছর বয়সে। তাবারির বর্ণনা প্রমাণ করে যে, আয়েশার অবশ্যই জন্ম হয়েছে ৬১৩ খ্রিষ্টাব্দে, ৬১০ খ্রিষ্টাব্দে নবীর কাছে ওহি নাজিল হতে শুরু করার তিন বছর পর। তাবারি আরো উল্লেখ করেছেন, আয়েশার জন্ম হয় ইসলামপূর্ব জাহেলিয়া যুগে। যদি তাঁর জন্ম ৬১০ খ্রিষ্টাব্দে, তাহলে নবীর সাথে আয়েশা যখন একত্রে থাকতে শুরু করেন তখন তার বয়স কমপক্ষে ১৪ বছর। কোনো সন্দেহ নেই, তাবারির বর্ণনা পরস্পরবিরোধী। এ পরিপেক্ষিতে আমরা বলতে পারি যে, বিয়ের সময় আয়েশার বয়স নিয়ে তাবারি যে তথ্য-উপাত্ত তুলে ধরেছেন তা বিশ্বাসযোগ্য নয়।
প্রমাণ ৩ : ফাতিমা-আয়েশার বয়স : তুলনামূলক পর্যালোচনা
ইবনে হাজরের মতে, কাবা পুনর্নির্মাণ করার সময় ফাতেমার জন্ম হয়। তখন নবীর বয়স ৩৫ বছর … ফাতেমা আয়েশার চেয়ে পাঁচ বছরের বড়। ইবনে হাজরের বক্তব্য যদি সঠিক বলে ধরে নেয়া হয় সেক্ষেত্রে নবীর বয়স যখন ৪০ বছর তখন আয়েশার জন্ম হয়। যখন নবীর বয়স ৫২ বছর, তখন যদি আয়েশা নবীকে বিয়ে করেন, তাহলে বিয়ের সময় আয়েশার বয়স ১২ বছর। যুক্তি তাই বলে। এ থেকে আমরা বলতে পারি যে, ইবনে হাজর, তাবারি, ইবনে হিশাম ও ইবনে হানবল আয়েশার কত বছর বয়সে বিয়ে হয়েছে তা নিয়ে যেসব তথ্য উপস্থাপন করেছেন তা পরস্পর বিরোধী ও অসঙ্গতিপূর্ণ। সুতরাং সাত বছর বয়সে আয়েশার বিয়ে হয়েছে বলে যে সাধারণ ধারণা তা অলিক কল্পকাহিনী বৈ অন্য কিছু নয়।
প্রমাণ ৪ : আসমা-আয়েশার বয়স : তুলনামূলক পর্যালোচনা
আবদুর রহমান ইবনে আবি জাননাদের মতে, আসমা আয়েশার চেয়ে ১০ বছরের বড়। ইবনে কাছিরের মতে, আসমা তার বোন আয়েশার তুলনায় ১০ বছরের বড়। ইবনে কাছিরের বক্তব্য অনুযায়ী, আসমা ৭৩ হিজরিতে তার ছেলের হত্যাকাণ্ড প্রত্যক্ষ করেছেন। এই হত্যাকাণ্ডের পাঁচ দিন পর তিনি ইন্তেকাল করেন। অন্যান্য বর্ণনা মোতাবেক, আসমা তার সন্তানের হত্যাকাণ্ডের পাঁচ দিন পর ইন্তেকাল করেননি বরং ১০ ২০ কিংবা এরও বেশি সময় ১০০ দিন পর তাঁর মৃত্যু হয়। মশহুর বর্ণনা হচ্ছে, সন্তানের হত্যাকাণ্ডের ১০ দিন পর আসমার মৃত্যু হয়। মৃত্যুকালে তার বয়স হয়েছিল ১০০ বছর।
ইবনে হাজর আল-আসকালানের মতে, আসমা ১০০ বছর বেঁচে ছিলেন এবং ৭৩ অথবা ৭৪ হিজরিতে তাঁর ইন্তেকাল হয়।
বেশির ভাগ ইতিহাসবিদের মত হচ্ছে, আসমা তার ছোট বোন আয়েশার চেয়ে ১০ বছরের বড়। ৭৩ হিজরিতে আসমার বয়স যদি ১০০ বছর হয়, তাহলে হিজরতের সময় তার স্বাভাবিক বয়স হয় ২৭-২৮। হিজরতের সময় আসমার বয়স যদি ২৭-২৮ বছর হয়, তাহলে আয়েশার বয়স স্বাভাবিকভাবে হয় ১৭ কিংবা ১৮ বছর। হিজরতের সময় আয়েশার বয়স ১৭-১৮ হলে নবীর সাথে আয়েশা একত্রে থাকতে শুরু করেন ১৯-২০ বছর বয়সের কোনো এক সময়।
হাজর, ইবনে কাছির ও আবদুর রহমান ইবনে আবি জাননাদের মত হলো, নবীর সাথে একত্রে বসবাস শুরু করার সময় আয়েশার বয়স হবে ১৯-২০। ইবনে হাজর একবার মত দেন যে (প্রমাণ ৩ উল্লেখিত) বিয়ের সময় আয়েশার বয়স ছিল ১২। অন্যত্র তিনি বলেন (প্রমাণ ৪ উল্লেখিত), বিয়ের সময় আয়েশার বয়স ১৭-১৮। তার বর্ণনা পরস্পর বিরোধী। তাহলে প্রশ্ন হচ্ছে বিয়ের সময় আয়েশার সঠিক বয়স কোনটি ১২ না ১৮? আয়েশার বিয়ের বয়স সম্পর্কে ইবনে হাজার যে বর্ণনা পেশ করেছেন উল্লেখিত কারণে তা উদ্ধৃত করার মতো নির্ভরযোগ্য নয়। (আগামীকাল সামাপ্য )
লেখক পরিচিতি : টি ও শানাবাস আমেরিকার মিশিগানে কর্মরত চিকিৎসক। প্রবন্ধটি মার্চ ১৯৯৯ সালে মিনারত পত্রিকায় প্রকাশিত হয়।