অনলাইন ডেস্ক ২৭ জুন, ২০২২ ১২:২৩
পদ্মা সেতু দিয়ে প্রতিদিন প্রায় ২৪ হাজার যানবাহন চলাচল করলে এর সবগুলোই রাজধানীকে স্পর্শ করবে। পদ্মা সেতু পার হয়ে ঢাকামুখী দক্ষিণাঞ্চলের এসকল যানবাহনের চাপ সামলাতে দ্রুত পকিল্পনা নিতে যাচ্ছে সরকার। এ সেতুর জন্য রাজধানী ঢাকার সাথে সরাসরি যুক্ত হতে যাচ্ছে দেশের দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চলের জনগণ। কিন্তু এ সেতুর যানবাহনের জন্য ঢাকা যেন ভোগান্তিতে পড়তে না হয়, সেজন্য বাড়তি যানবাহনের চাপ সামাল দিতে প্রস্তুত করতে হবে ঢাকাকে।রাজধানীর অসহনীয় যনজট কমাতে প্রয়োজন বৃত্তাকার সড়ক। পদ্মা সেতু চালু হলে যানবাহনের চাপ বাড়বে। এসব যানবহানকে ঢাকার ভেতর দিয়ে পদ্মা সেতুতে ওঠতে হবে। ফলে পদ্মা সেতু চালু হলে ঢাকার যানজট আরও ভয়াবহ রূপ নিতে পারে। এম আশঙ্কা করছেন বিশেষজ্ঞরা। সেক্ষেত্রে ঢাকা ঘিরে বৃত্তাকার সড়ক নির্মাণ একটি ভাল সমাধান হতে পারে বলে মনে করছেন তারা। পদ্মা সেতু পাড়ি দিয়ে ২১ জেলায় যাবে যানবাহন। তাছাড়া সেতু কেন্দ্র করে চলাচলও বাড়বে। সেতুর কারণে জেলাগুলোর অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ডও বাড়বে। জেলায় নতুন নতুন শিল্প কারখানা গড়ে উঠবে। এই সেতু দিয়েই বাংলাদেশ ভবিষ্যতে এশিয়ান হাইওয়েতে যুক্ত হবে।
সংশ্লিষ্টরা বলছেন, পদ্মা সেতু পাড়ি দিয়ে যেসব যানবাহন ঢাকায় ঢুকবে সেক্ষেত্রেও যানজট বাড়ার আশঙ্কা রয়েছে। যেসব যানবাহন ঢাকায় ঢুকবে সেগুলো এক্সপ্রেসওয়ে পাড় হয়ে মেয়র হানিফ ফ্লাইওভারে উঠবে। এসব যানবাহন মেয়র হানিফ ফ্লাইওভারের এক্সিটগুলোতে নামবে। সায়দাবাদ, যাত্রাবাড়ি, গুলিস্তান ও চানখারপুলে নামবে এসব যানবাহন। এসব এলাকায় এমনিতেই যানজট থাকে। তার ওপর সেতু চালু হলে অতিরিক্ত যানবাহনের চাপ বাড়বে। ফলে এখনই বিকল্প ভাবা দরকার। এখন পর্যন্ত এমন কোনো রাস্তা করা হয়নি যা দিয়ে ঢাকার ভেতরে না ঢুকেও পদ্মা সেতুতে উঠতে পারবে যানবাহনগুলো। এক্ষেত্রে যদি ঢাকা ঘিরে বৃত্তাকার একটি সড়কপথ তৈর করা যেত তাহলে ঢাকার ওপর অতিরিক্ত চাপ পড়ত না। এক্ষেত্রে একটি পরিকল্পনা থাকলেও এখন পর্যন্ত তা বাস্তবায়িত হয়নি। ঢাকার দোলাইরপাড় থেকে পদ্মা সেতু পর্যন্ত এক্সপ্রেসওয়ে নির্মাণ করা হয়েছে। কিন্তু এক্সপ্রেসওয়েতে উঠতে গেলেও ঢাকার অসহনীয় যানজট অতিক্রম করেই যেতে হবে।
নগর পরিকল্পনাবিদরা বলছেন, বৃত্তাকার সড়ক নির্মাণ করলে এই ভয়াবহ যানজট সৃষ্টির আশঙ্কা থাকবে না। ঢাকা-ময়মনসিংহ সড়কের গাড়ি রাজধানীর ভেতর দিয়ে বাবুবাজার সেতু হয়ে মাওয়া যেতে হয়। কিন্তু সার্কুলার রোড থাকলে আবদুল্লাহপুর হয়ে বৃত্তাকার সড়ক দিয়ে মাওয়া চলে যেতে পারত গাড়িগুলো।
জানা যায়, ঢাকা শহর ঘিরে ৮৮ দশমিক ৮ কিলোমিটার দীর্ঘ বৃত্তাকার সড়ক পথ নির্মাণের প্রকল্প হাতে নেয়া হয়েছিল। এর ফলে ঢাকার ভেতরে না ঢুকেও গাড়িগুলো বের হয়ে যেতে পারত। কিন্তু সেই প্রকল্প এখনো বাস্তবায়ন শুরু করা সম্ভব হয়নি। এই বৃত্তাকার সড়ক পথ অনেক আগেই করার কথা ছিল। ২০০৪ সালে যানজট নিরসন মহাপরিকল্পনায় ছিল এই প্রস্তাব। ২০১৪ সালে সংশোধিত এসটিপিতেও ঢাকা ঘিরে তিনটি বৃত্তাকার সড়ক নির্মাণের কথা আছে। কিন্তু সবকিছু এখনো পরিকল্পনাতেই রয়ে গেছে।
ইনস্টিটিউট ফর প্ল্যানিং অ্যান্ড ডেভেলপমেন্টের (আইপিডি) নির্বাহী পরিচালক ও জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের নগর ও অঞ্চল পরিকল্পনা বিভাগের অধ্যাপক ড. আদিল মুহাম্মদ খান বলেন, ঢাকা থেকে মাওয়া পর্যন্ত এলাকার ভূমি ব্যবহার পরিকল্পনা এখনই চূড়ান্ত করে ফেলা দরকার। না হলে এই সেতুকে কেন্দ্র করে যানবাহনের চাপ সামলানো মুশকিল হয়ে যাবে। চাপ সামলাতে প্রয়োজনীয় সড়ক অবকাঠামো নির্মাণ ও পরিবহণ পরিকল্পনার উপর জোর দিতে হবে।
বিশেষজ্ঞরা বলছেন, ২০ বছরের পরিবহন পরিকল্পনায় (এসটিপি) ঢাকায় ইনার ও আউটার—দুই ধরনের বৃত্তাকার সড়ক গড়ে তোলার কথা বলা হয়েছে। এরই অংশ হিসেবে সাভারের হেমায়েতপুর থেকে কেরানীগঞ্জ হয়ে নারায়ণগঞ্জ সদর পর্যন্ত উড়াল সড়ক করা হবে। ঢাকা ঘিরে নির্মাণ করা হবে বৃত্তাকার সড়ক।
পদ্মা সেতু দিয়ে ২০২২ সালে দিনে ২৩ হাজার ৯৫৪টি যানবাহন চলাচল করবে। ২০৩০ সালে তা বেড়ে দাঁড়াবে ৩৬ হাজার ৭৮৫টি। চার লেনের এই সেতুতে দিনে সর্বোচ্চ ৭৫ হাজার যানবাহন চলাচলের সক্ষমতা আছে। পদ্মা সেতু পার হয়ে ফরিদপুর, বরিশাল, খুলনামুখী যানবাহনের জন্য ভাঙ্গায় তৈরি করা হয়েছে বহুমুখী উড়ালপথ (ক্লোভারলিফ ইন্টারচেঞ্জ)। পদ্মা সেতুকে ঘিরে সরকার ঢাকা থেকে মাওয়া হয়ে ফরিদপুরের ভাঙ্গা পর্যন্ত ৫৫ কিলোমিটার জাতীয় মহাসড়ক (এন-৮) ছয় লেনে উন্নীত করে।
পদ্মা সেতু থেকে কেরানীগঞ্জ এসে রাজধানীতে প্রবেশের দুটি পথ তৈরি হয়েছে। এগুলো হচ্ছে পোস্তগোলা ও বাবুবাজার সেতু। ঢাকা-চট্টগ্রাম, ঢাকা-সিলেট, ঢাকা-উত্তরবঙ্গের যানবাহন পদ্মা সেতু হয়ে যাতায়াত করতে হলে ঢাকার ওপর দিয়ে যেতে হবে।
সড়ক ও জনপথ (সওজ) অধিদপ্তরের সূত্র বলছে, উত্তরবঙ্গ ও ঢাকা-চট্টগ্রাম এবং ঢাকা-সিলেট রুটের যানবাহন নির্বিগ্নে চলাচলের জন্য বিকল্প আউটার সার্কুলার রোড নির্মাণের প্রকল্প নিয়েছে সরকার। প্রস্তাবিত উড়ালসড়কের দৈর্ঘ্য প্রায় ৪০ কিলোমিটার। সাভারের হেমায়েতপুর থেকে এটি কেরানীগঞ্জের কলাতিয়া, ফতুল্লা, নারায়ণগঞ্জ সদরে যাওয়ার কথা। ২০১৭ সালে সম্ভাব্যতা যাচাই সমীক্ষা হয়। পরিকল্পনা অনুসারে, ২০২৪ সালে এই উড়ালসড়ক চালু হওয়ার কথা। এতে জাপান অর্থায়ন করতে চেয়েছে। তবে এখনো ঋণ চুক্তি হয়নি।
নারায়ণগঞ্জ শহর ও বন্দরকে যুক্ত করতে তৃতীয় শীতলক্ষ্যা সেতুর নির্মাণকাজ চলছে। এই সেতু চালু হলে উড়ালসড়কটি নারায়ণগঞ্জের মদনের কাছে ঢাকা-চট্টগ্রাম মহাসড়ককে যুক্ত করবে। ঢাকা-সিলেট মহাসড়কের সঙ্গে সরাসরি সংযোগ না হলেও বাইপাসের মাধ্যমে পরোক্ষভাবে যুক্ত হয়ে যাবে। ঢাকা-পাটুরিয়া হয়ে খুলনা মহাসড়ক এবং নবীনগর হয়ে ঢাকা-উত্তরবঙ্গের সব মহাসড়ক যুক্ত হবে হেমায়েতপুরে।
ঢাকা ঘিরে প্রায় ৮৯ কিলোমিটার দীর্ঘ আরেকটি বৃত্তাকার ইনার সার্কুলার রোড নির্মাণের পরিকল্পনা রয়েছে। এটি দুই ভাগে বিভক্ত। একটি আবদুল্লাহপুর রেলগেট থেকে তেরমুখ, পূর্বাচল, বেরাইদ হয়ে ডেমরা পর্যন্ত প্রায় ২৬ কিলোমিটার।
অন্য সড়কটি আবদুল্লাহপুর রেলগেট থেকে ধউর, বিরুলিয়া, গাবতলী, বছিলা, হাজারীবাগ, সোয়ারীঘাট, কদমতলী, তেঘরিয়া, পোস্তগোলা, ফতুল্লা, চাষাঢ়া, শিমরাইল হয়ে ডেমরা পর্যন্ত ৬৩ কিলোমিটার। বাকি ৪৭ কিলোমিটার সড়ক নতুন করে নির্মাণ করতে হবে। এ জন্য ১২ হাজার কোটি টাকার প্রকল্প নেওয়া হয়েছে। তবে এখনো অর্থ বরাদ্দ হয়নি।
ফরিদপুরের ভাঙ্গা থেকে খুলনা ও বরিশাল বিভাগ এবং গোপালগঞ্জ, ফরিদপুরসহ অন্যান্য জেলায় যাওয়ার সব পথই দুই লেনের। ভাঙ্গা থেকে কুয়াকাটা সড়ক চার লেনে উন্নীত করতে ২০১৮ সালের শেষের দিকে একনেকে একটি প্রকল্প পাস হয়।