সিলেট ব্যুরো ।২৭ জুন ২০২২,১২:৩০

ভয়াবহ বন্যার কবলে পড়া সিলেটে ক্ষয়ক্ষতির যেন কোনো শেষ নেই। বাড়িঘর, ফসল, প্রাণিসম্পদ সবক্ষেত্রেই হয়েছে ব্যাপক ক্ষতি। আটকে থাকা পানি নামার সাথে সাথে এখন সর্বত্র দৃশ্যমান হচ্ছে ধ্বংসস্তূপের চিত্র। তবে ৮০ ভাগেরও বেশি এলাকা এখনো পানিতে টইটুম্বুর।
জেলা প্রশাসন সূত্রে জানা গেছে, বন্যায় সিলেট সিটি করপোরেশনের আংশিক এলাকাসহ জেলার ১৩টি উপজেলা ও পাঁচটি পৌরসভা ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। ৯৯টি ইউনিয়নের চার লাখ ১৬ হাজার ৮১৯টি পরিবারের ২১ লাখ ৮৭ হাজার ২৩২ জন সদস্য বন্যায় ক্ষতির মুখে পড়েছে। এ ছাড়া ২২ হাজার ৪৫০টি ঘরবাড়ি বন্যায় ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। ২৮ হাজার ৯৪৫ হেক্টর জমির ফসল পড়েছে ক্ষতির মুখে।
এসব এলাকার জন্য দুর্যোগ ও ত্রাণ মন্ত্রণালয় থেকে এক হাজার ৪১২ মেট্রিক টন চাল, ১৩ হাজার ২১৮ প্যাকেট শুকনো খাবার এবং এক কোটি ৪২ লাখ টাকা বরাদ্দ দেয়া হয়েছে বলে জেলা প্রশাসন থেকে জানা গেছে। তবে জেলা প্রশাসনের এ হিসাবের চেয়ে প্রকৃত ক্ষতি আরো কয়েক গুণ বেশি বলে জানাচ্ছে স্থানীয় সূত্রগুলো।
সড়ক বিভাগ ও এলজিইডি সূত্র বলছে, জেলার সড়ক বিভাগের প্রায় ১২৫ কিলোমিটার সড়ক তলিয়ে গেছে। বন্যার ভয়াবহ বিপর্যয়ের পর সড়ক ও জনপথ বিভাগের আওতাধীন সড়কগুলো দেখলে যে কেউ আঁতকে উঠবেন। বন্যার ভয়াবহতা সহজেই অনুমান করা যাচ্ছে এই সড়কের ক্ষত চিহ্নগুলো দেখার পর। পানির চাপ এতটাই শক্তিশালী ছিল যে ঘূর্ণিঝড়ে গাছ-ঘরবাড়ি যেমন দুমড়েমুচড়ে যায়, ঠিক তেমনিভাবে দুমড়েমুচড়ে গেছে সড়ক।
এ দিকে, সিলেটের স্বাস্থ্যখাতেও নজিরবিহীন ক্ষয়ক্ষতি হয়েছে। সিলেট শহীদ শামসুদ্দীন আহমেদ হাসপাতালের নিচতলা প্রায় তিন ফুট পানিতে তলিয়ে যায়। ওসমানী মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালের জেনারেটর জলমগ্ন হওয়ায় হাসপাতালের বিকল্প বিদ্যুৎ সরবরাহের ব্যবস্থা ভেঙে পড়ে। নিচতলায় পানি উঠে যাওয়ায় রোগীরা পড়েন চরম দুর্ভোগে। পানি নামার পর দেখা যায়, হাসপাতালটির এমআরআই, সিটিস্ক্যান ও রেডিও থেরাপি মেশিনে পানি ঢুকে গেছে। ফলে বন্ধ রয়েছে এসব সেবাকার্যক্রম। এবারের বন্যায় শুধু ওসমানী হাসপাতালেই নয়, ক্ষতিগ্রস্ত করেছে বিভাগের অনেক সরকারি হাসপাতাল, স্বাস্থ্যকমপ্লেক্স ও কমিউনিটি ক্লিনিক। ফলে বিভাগজুড়ে স্বাস্থ্যসেবা বিঘিœত হচ্ছে।
বন্যায় আক্রান্ত স্বাস্থ্য প্রতিষ্ঠানের তথ্যাদি সংক্রান্ত প্রতিবেদনে স্বাস্থ্য অধিদফতর উল্লেখ করে, সিলেট বিভাগের মোট ৪০টি স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সের মধ্যে ২৪টি বন্যাকবলিত হয়েছে। ৮৫টি ইউনিয়ন সাব-সেন্টারের মধ্যে ৩১টিতে পানি ঢুকেছে। সুনামগঞ্জে ২০ শয্যার দু’টি হাসপাতালে পানি প্রবেশ করে। এ ছাড়াও ৯২৭টি কমিউনিটি ক্লিনিকের মধ্যে ৪১৪টি ক্লিনিক পানিতে নিমজ্জিত হয়। জেলার তিনটি উপজেলা (জৈন্তাপুর, বিয়ানীবাজার, গোলাপগঞ্জ) বাদ দিয়ে বাকি ১০টি উপজেলার সব স্বাস্থ্য প্রতিষ্ঠান সম্পূর্ণভাবে জলমগ্ন ছিল। কোম্পানীগঞ্জ ও গোয়াইনঘাট উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সে প্রায় ১০ ফুট পরিমাণ পানি ছিল। স্রোতের কারণে অনেক আসবাবপত্র ভেসে গেছে এসব প্রতিষ্ঠানের।
সিলেট স্বাস্থ্য বিভাগের প্রতিবেদনে উল্লেখ করা হয়, সকল উপদ্রুত স্বাস্থ্য প্রতিষ্ঠানে অবকাঠামোগত ব্যাপক ক্ষয়ক্ষতি হয়েছে। অনেক স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সে বৈদ্যুতিক সরঞ্জামাদি, ইপিআই আইএলআর ফ্রিজ, প্যাথলজিক্যাল পরীক্ষা-নিরীক্ষার যন্ত্রপাতি, এক্সরে মেশিন, এমএসআর সামগ্রী নষ্ট হয়ে গেছে। জলমগ্ন এসব যন্ত্রপাতি কতটা সচল কিংবা অচল তা পানি নেমে না যাওয়ায় যাচাই করা যাচ্ছে না। সার্বিক ক্ষয়ক্ষতির পরিমাণ জানাতে আরও সময় লাগবে।
এ দিকে বিভাগের চার জেলায় এখনো ৮০ ভাগ এলাকা পানিতে ভাসছে। কেবল সিলেটের সুরমা অঞ্চল ঘেরা বিভিন্ন নদীর পানি কিছুটা কমার খবর পাওয়া গেছে। অন্য দিকে সিলেট নগর ও আশপাশের এলাকায় বন্যার পানি অনেকটাই কমেছে। তবে এখন রাস্তাঘাটে জমে থাকা বন্যার ময়লা পানি থেকে দুর্গন্ধ ছড়াতে শুরু করেছে। পানি কমতে শুরু করায় অনেকেই আশ্রয়কেন্দ্র ছেড়ে বাড়িতে ফিরতে শুরু করেছেন।
গতকাল রোববার দুপুরে নগরের বিভিন্ন এলাকা ঘুরে দেখা গেছে, প্রধান সড়কগুলোর যেসব স্থানে পানি জমে ছিল, সেগুলো থেকে পানি নেমে গেছে। তবে কিছু সড়কে এখনো পানি রয়েছে। এর মধ্যে শাহজালাল উপশহরের কিছু গলি, তালতলা সড়কসহ বিভিন্ন পাড়া-মহল্লার সড়কগুলোতেও পানি রয়ে গেছে। তবে সব কয়টি সড়কেই যানবাহন চলাচল করতে দেখা গেছে। নগরের যতরপুর, মিরাবাজার, শাহজালাল উপশহর, সোবহানীঘাট, মির্জাজাঙ্গাল, তালতলা, জামতলা, শেখঘাট, ঘাসিটুলা, কুয়ারপাড়, লালাদিঘীর পাড় এলাকার পাড়া-মহল্লার পানি ময়লা ও কালো রঙ ধারণ করেছে। এসব স্থানে জমে থাকা পানি থেকে দুর্গন্ধ ছড়াচ্ছে। উপশহর এলাকার বাসিন্দা রায়হান আহমদ চৌধুরী নাহিদ বলেন, পানি কমে যাওয়ার পর নতুন করে ভোগান্তি শুরু হয়েছে। আগে বেশি পানি থাকায় পানি কিছুটা ঘোলা থাকলেও তেমন ময়লা ছিল না। এখন পানি ময়লা হয়ে কালো রঙ ধারণ করেছে। প্রতিনিয়ত ময়লা পানি মাড়িয়ে চলাফেরা করতে হচ্ছে। এতে সবার পায়ে চুলকানি হচ্ছে।
বিয়ানীবাজারে বৃদ্ধার লাশ উদ্ধার
বিয়ানীবাজার (সিলেট) সংবাদদাতা জানান, গত শনিবার বিকেল ৪টার দিকে বাড়ির আঙ্গিনা থেকে নিখোঁজ হন বৃদ্ধা দিলওয়ারা বেগম (৯০)। অনেক খোঁজাখুঁজির পর না পেয়ে স্বজনরা ধারণা করেন, উঠানের গা ঘেঁষে বয়ে যাওয়া সোনাই নদীতে হয়তো তিনি তলিয়ে গেছেন। সারা রাত নদীতে নৌকা দিয়ে খোঁজ করেও পাননি। অবশেষে গতকাল রোববার সকাল ৭টার দিকে তার লাশ পাওয়া যায় কয়েক কিলোমিটার দূরে সানাই নদীর তিলপাড়া ইউনিয়নের শানেশ্বর এলাকায়।
দিলওয়ারা বেগম বিয়ানীবাজার উপজেলার লাউতা ইউনিয়নের টিকরপারা এলাকার শ্রীপুরের বাসিন্দা। তিনি ইউপি সদস্য ইসলাম উদ্দিনের মা। রোববার সকাল নদীতে মাছ ধরার সময় জেলেরা ভাসমান লাশ দেখে ইউপি সদস্য ইসলাম উদ্দিনকে খবর দেন। খবর পেয়ে লাউতা ইউনিয়নের চেয়ারম্যান দেলোয়ার হোসেন, ছেলে ইসলাম উদ্দিনসহ স্বজনরা ঘটনাস্থলে গিয়ে লাশ শনাক্ত করেন এবং বিয়ানীবাজার থানা পুলিশের সহযোগিতায় লাশ উদ্ধার করেন। ইসলাম উদ্দিন বলেন, বাড়ির চার পাশে বন্যার পানি। ঘর থেকে বের হয়ে অসাবধানতাবশত হয়তো সুনাই নদী পড়ে যান। নদীতে প্রচণ্ড স্রোত থাকায় পরিবারের কেউ টের পাননি।
এর আগে গত ২৩ জুন ভোরে পানিবন্দী ঘর থেকে এক বৃদ্ধের লাশ উদ্ধার করা হয়। পরিবারের অন্য সদস্যরা আশ্রয়কেন্দ্রে থাকলেও রাতে তিনি ঘর ও আসবাপত্র দেখতে গিয়ে আর ফিরে আসেননি। পরের দিন সকালে তার লাশ ভাসমান অবস্থায় পাওয়া যায়।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *