২২ জুন ২০২২, ২১:৩০
এতদিনকার খবর ছিল, ফিলিস্তিনিদের বাড়িঘর বুলডোজার দিয়ে গুঁড়িয়ে দিচ্ছে ইসরাইল। গাজা, রামাল্লা, পশ্চিমতীর, জেনিনসহ ফিলিস্তিনের কয়েক ডজন জনপদের নাম পরিচিতি পেয়েছে ঘরবাড়ি হারানো মানুষের আর্তনাদে। ইসরাইল এই নীতি নিয়েছে মানুষের স্বতঃস্ফূর্ত প্রতিবাদের শক্তিকে স্তব্ধ করে দেয়ার জন্য। দেশটি প্রশাসনিক উদ্যোগে এ নির্মম অমানবিক ধ্বংসাত্মক কার্যক্রম চালিয়ে যাচ্ছে। সরাসরি সরকারি প্রশাসনের ছত্রছায়ায় জনপদের অধিবাসীদের উচ্ছেদ করার উদ্যোগ পৃথিবীর অন্য কোথাও দেখা যায় না। এ পর্যন্ত তারা ফিলিস্তিনিদের তিন হাজারের বেশি ঘরবাড়ি পিষে ফেলেছে। ভিটেমাটি থেকে মানুষকে উপড়ে ফেলার নির্দয় কার্যক্রম সারা বিশ্বে ধিকৃত ও নিন্দিত হলেও গায়ের জোরে ইসরাইলিরা চালিয়ে যাচ্ছে।
চরম নিন্দনীয় কাজটি এবার শুরু করেছে বিশ্বের বৃহত্তম গণতান্ত্রিক দেশ ভারত। উত্তরপ্রদেশে যোগী আদিত্যনাথের সরকার বুলডোজার দিয়ে গুঁড়িয়ে দিয়েছে এক মুসলমানের দোতলা বাড়ি। ‘অপরাধ’ হচ্ছে বাড়ির বাসিন্দা মোহাম্মদ এবং তার মেয়ে ফাতিমা মুসলমানদের স্বার্থ রক্ষায় প্রতিবাদ-সমাবেশের আয়োজনে ‘ইন্ধন’ দিয়েছেন। ফাতিমা একজন ছাত্রনেতা। তার বাবা স্থানীয় একটি রাজনৈতিক দলের সদস্য। জনবসতি উচ্ছেদে ইসরাইল কিছু আইন করেছে; তারা মোটামুটি সেটি মানে। প্রথমে তারা বাড়ির মালিকের বিরুদ্ধে তার ‘অপরাধ’ উল্লেখ করে নোটিশ দেয়। ভারতের উত্তরপ্রদেশে এ বাড়ি উচ্ছেদে সরকার কোনো আইন নিয়মকানুন অনুসরণ করেনি। উচ্ছেদের পর যে সরকারি ভাষ্য পাওয়া যাচ্ছে তাতে বলা হয়েছে, বাড়িটি অবৈধভাবে তৈরি করা হয়েছে। এ অভিযোগ তারা আনছে পরিবারের প্রধান মোহাম্মদের বিরুদ্ধে। কিন্তু বাড়িটির প্রকৃত মালিক তার স্ত্রী। ভারত সরকার এতটাই বেপরোয়া হয়ে উঠছে, ইসরাইল যে ন্যূনতম ভদ্রতা বজায় রাখে তাও তারা রাখতে পারেনি। এখনো ইসরাইল রাষ্ট্রের নামে আগে সেঁটে যাওয়া ‘বর্ণবাদী’ দুর্নামটি ভারতের বিরুদ্ধে লাগেনি। মন্দির নির্মাণের জন্য এরই মধ্যে ভারত সরকার আসাম ও ত্রিপুরায় মুসলমানদের বসতি উচ্ছেদ করেছে। রাজধানী দিল্লিতেও একই অভিযান প্রশাসন চালিয়েছে।
ফিলিস্তিনিদের প্রতি ভারতের একটি অঙ্গীকার ছিল। বিশ্বের দ্বিতীয় বৃহৎ মুসলমান অধ্যুষিত দেশ হিসেবে এ অঙ্গীকার তারা রক্ষা করে চলছিল। মুসলমান জনসংখ্যার স্বার্থ বিবেচনায় ইসরাইল-ফিলিস্তিন নিয়ে একটি ভারসাম্য নীতি তারা দীর্ঘ দিন বজায় রেখেছিল। নরেন্দ্র মোদি ক্ষমতায় আসার পর ‘শত্রুর শত্রু বন্ধু’ হওয়ার নীতি এখানে তুরুপের তাস হয়েছে। দেশটির ইসরাইল নীতি তাই বদলে গেছে। ২০১৭ সালে মোদির ইসরাইল সফরের পর সেটি পুরোপুরি ভিন্ন দিকে মোড় নেয়। ভারত-ইসরাইল এখন কৌশলগত মিত্র ও অংশীদার। উভয় জায়গায় নির্দয়তার শিকার বৈশ্বিক পরাশক্তির সমর্থনহীন দুর্বল মুসলমানরা। ইসরাইল যেমন তাদের অস্তিত্বের জন্য মুসলমানদের শত্রু বলে গণ্য করে, বিজেপির নেতৃত্বে ভারত সরকার ঠিক একই ধরনের মত পোষণ করে। মুসলমানদের উৎখাতে এখন ইসরাইলের মতোই ভারত বেপরোয়া।
নবী অবমাননা নিয়ে মুসলমান দেশগুলোর বড় ধরনের প্রতিক্রিয়ার পর গণতান্ত্রিক দেশ হিসেবে ভারতের নমনীয় হওয়ার কথা ছিল; বিশেষ করে তাদের ওপর এর গভীর অর্থনৈতিক প্রভাব পড়ার আশঙ্কা যেখানে তৈরি হয়েছে। পরিস্থিতি সামাল দেয়ার জন্য অপরাধীদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেয়া প্রাধান্য পাওয়ার কথা ছিল। তার বদলে দেশজুড়ে মুসলমানদের ওপর উল্টো নিপীড়নের স্টিম রোলার নেমে আসছে। ভাইরাল হওয়া একটি ভিডিওফুটেজে দেখা যাচ্ছে, নির্মম পেটাচ্ছে পুলিশ কাস্টডিতে থাকা একদল মুসলমান তরুণকে। ১৮ জুন বিবিসি এক খবরে জানাচ্ছে, এটি কয়েক মিলিয়ন মানুষ দেখেছে। বিজেপির একজন নির্বাচিত কর্মকর্তা নির্যাতনের ঘটনাটি শেয়ার করে লিখেছেন, মুসলমানদের প্রতি এটি ‘গিফট’। এ সব তরুণ গত জুমার নামাজ শেষে সাহরানপুরে মিছিলে অংশ নিয়েছিল। ওই মিছিলটি ছিল শান্তিপূর্ণ। এ অপরাধী পুলিশ সদস্যদের বিরুদ্ধে কোনো ধরনের ব্যবস্থা নেয়া হয়নি। অরুন্ধতী রায় বলেছেন, ভারতে মুসলমানরা এখন কোনো ধরনেরই প্রাতিষ্ঠানিক সুবিধা পাচ্ছেন না। পুলিশ, বিচার বিভাগ এমনকি প্রশাসনের কোনো জায়গা থেকে তাদের অধিকার দেয়া হচ্ছে না। বিজেপি সরকারের সেনাবাহিনীর নতুন নিয়োগ নীতি নিয়ে ভারতজুড়ে এক দল ট্রেন জ্বালিয়ে দিয়েছে, রাস্তা অবরোধ করেছে; এমনকি তারা বিজেপির অফিস পুড়িয়ে দিয়েছে। ওই সব লোকের বাড়িঘর গুঁড়িয়ে দেয়া হয়নি।’ এটি অরুন্ধতী রায় আলজাজিরায় প্রকাশিত বক্তব্যে উল্লেখ করেছেন। বিজেপির উদ্দেশ্য বুঝতে তাই অসুবিধা হয় না। তারা পুরো ভারতকে আরেকটি ফিলিস্তিন বানাবে। মুসলমানদের তাড়িয়ে দেয়ার নীতিই তারা বাস্তবায়ন করবে। এরই পদ্ধতিগত হিংসাত্মক পদক্ষেপ এগিয়ে চলেছে।