০১ সেপ্টেম্বর ২০২২, ২০:১৮

ছবি বিবিসি

শিনজিয়ান প্রদেশে চীন উইঘুর মুসলমানদের প্রতি “গুরুতর মানবাধিকার লঙ্ঘন” করেছে বলে মনে করছে জাতিসংঘ। এই বিষয়ে এক দীর্ঘ প্রতীক্ষিত প্রতিবেদন প্রকাশ করেছে সংস্থাটি।

চীন জাতিসংঘকে প্রতিবেদনটি প্রকাশ না করার আহ্বান জানিয়েছিল। বেইজিং এটিকে পশ্চিমা শক্তির সাজানো একটি “প্রহসন” বলে অভিহিত করেছে।প্রতিবেদনে উইঘুর মুসলিম এবং অন্যান্য জাতিগত সংখ্যালঘুদের বিরুদ্ধে নির্যাতনের অভিযোগ খতিয়ে দেখা হয়েছে,চীন যা অস্বীকার করে।

জাতিসংঘের প্রতিবেদনে কী বলা হয়েছে?

তদন্তকারীরা বলেছেন যে তারা নির্যাতনের “গ্রহণযোগ্য প্রমাণ” খুঁজে পেয়েছেন, যা সম্ভবত “মানবতার বিরুদ্ধে অপরাধ”।তারা সংখ্যালঘুদের অধিকার দমন করার জন্য একটি অস্পষ্ট জাতীয় নিরাপত্তা আইন ব্যবহার করা এবং “বিধিবহির্ভূতভাবে আটকে রাখার ব্যবস্থা” প্রতিষ্ঠার জন্য চীনকে অভিযুক্ত করেছে।

জাতিসংঘের মানবাধিকার বিষয়ক হাইকমিশনারের কার্যালয় থেকে এই প্রতিবেদন তৈরি করার দায়িত্ব দেয়া হয়েছিল। ওই প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, আটক বন্দীদের সঙ্গে অপরাধমূলক আচরণ করা হয়েছে, যার মধ্যে “যৌন ও লিঙ্গ ভিত্তিক সহিংসতার ঘটনা” রয়েছে।কেউ কেউ জোরপূর্বক “পরিবার পরিকল্পনা ও জন্মনিয়ন্ত্রণ নীতির বৈষম্যমূলক প্রয়োগের” শিকার হয়েছেন।

জাতিসংঘ সুপারিশ করেছে যে চীন যেন অবিলম্বে “স্বাধীনতা থেকে বঞ্চিত সকল ব্যক্তিকে মুক্তি দেওয়ার” পদক্ষেপ গ্রহণ করে। জাতিসংঘ বলছে, বেইজিংয়ের কিছু পদক্ষেপ “মানবতার বিরুদ্ধে অপরাধ সহ আন্তর্জাতিক অপরাধ” হিসাবে গণ্য হতে পারে।

জাতিসংঘ অবশ্য বলেছে যে চীনের সরকার কত লোককে আটকে রেখেছে তা নিশ্চিত করা যায়নি। মানবাধিকার গোষ্ঠীগুলো অনুমান করে যে উত্তর-পূর্ব চীনের শিনজিয়ান অঞ্চলের শিবিরে দশ লক্ষের বেশি লোককে আটক রাখা হয়েছে। জাতিসংঘ বলেছে, এতে অমুসলিমরাও থাকতে পারে।শিনজিয়ানে প্রায় এক কোটি কুড়ি লক্ষ উইঘুর মুসলমান বাস করে।এর আগে বেশ কয়েকটি দেশ শিনজিয়ানে চীনের কর্মকাণ্ডকে গণহত্যা বলে বর্ণনা করেছিল।

প্রতিবেদনটি প্রকাশিত হওয়ার আগেই বেইজিং সেটি দেখেছে এবং কোন ধরনের নির্যাতনের অভিযোগ অস্বীকার করেছে। চীন যুক্তি দিয়েছে যে এই শিবিরগুলি সন্ত্রাসবাদের বিরুদ্ধে লড়াই করার একটি হাতিয়ারজাতিসংঘের মানবাধিকার বিষয়ক হাইকমিশনার হিসেবে চার বছর দায়িত্বে থাকার পর তার মেয়াদের শেষ দিনে মিশেল ব্যাচেলেটের এই প্রতিবেদনটি প্রকাশ করা হয়।

উইঘুরদের বিরুদ্ধে নির্যাতনের অভিযোগ তার পুরো মেয়াদকালে প্রাধান্য পেয়েছে।এক বছরেরও বেশি সময় আগে তার কার্যালয় থেকে ইঙ্গিত দেয়া হয়েছিল যে শিনজিয়ানে গণহত্যার অভিযোগের তদন্ত চলছে।কিন্তু প্রতিবেদনটির প্রকাশনা বেশ কয়েকবার বিলম্বিত হয়। যার ফলে কিছু পশ্চিমা মানবাধিকার গোষ্ঠী অভিযোগ করে যে প্রতিবেদন থেকে কিছু গুরুতর অভিযোগ চেপে যাওয়ার জন্য বেইজিং অনুরোধ করছে।

এমনকি প্রতিবেদনটি প্রকাশের শেষ কয়েক ঘণ্টার মধ্যেও চীন মিজ ব্যাচেলেটকে এটি প্রকাশ না করার জন্য চাপ দিয়েছে।গত বৃহস্পতিবার এক সংবাদ সম্মেলনে তিনি স্বীকার করেন যে তিনি এই প্রতিবেদনটি ‘প্রকাশ করা বা না করার জন্য প্রচণ্ড চাপের মধ্যে ছিলেন’।কিন্তু তিনি প্রতিবেদনটি দেরিতে প্রকাশ করা সম্পর্কে যুক্তি দিয়ে বলেন, প্রতিবেদনটি নিয়ে বেইজিংয়ের সাথে আলাপ করার অর্থ এই নয় যে তিনি এর বিষয়বস্তু “না দেখার ভান” করেছেন।

মানবাধিকার গোষ্ঠীগুলোর সমালোচনা

চীনে হিউম্যান রাইটস ওয়াচ-এর পরিচালক সোফি রিচার্ডসন বলেছেন, প্রতিবেদনে যা উঠে এসেছে তাতে পরিষ্কার যে “চীনা সরকার কেন প্রতিবেদনের প্রকাশ ঠেকাতে লড়াই করেছে”।”জাতিসংঘের মানবাধিকার পরিষদের উচিত হবে উইঘুর এবং অন্যান্যদের উপর চীনা সরকারের মানবতাবিরোধী অপরাধের একটি ব্যাপক তদন্ত শুরু করার জন্য এই প্রতিবেদনটি ব্যবহার করা এবং দায়ীদেরকে জবাবদিহিতার আওতায় আনা,” তিনি বলেন।

সোফি রিচার্ডসন আরও বলেন, “উইঘুর এবং অন্যান্য ভুক্তভোগীরা যে কতটা নির্যাতনের সম্মুখীন হয়েছে সে সম্পর্কে তদন্ত করার জন্য আপনাদের উপর তারা আস্থা রেখেছেন।””আপনি যদি নির্যাতিতদের পক্ষে না দাঁড়ান, তাহলে কে দাঁড়াবে?”

অ্যামনেস্টি ইন্টারন্যাশনালের সেক্রেটারি জেনারেল অ্যাগনেস ক্যালামার্ড প্রতিবেদনটি প্রকাশে বিলম্বকে “অমার্জনীয়” উল্লেখ করে তার নিন্দা করেছেন।”মানবতার বিরুদ্ধে অপরাধের জন্য চীনা সরকারকে অবশ্যই জবাবদিহিতার মুখোমুখি হতে হবে। দায়ী ব্যক্তিদের চিহ্নিত করা এবং তাদের বিচারের মাধ্যমে জবাবদিহিতার আওতায় আনতে হবে,” বলেন মিজ ক্যালামার্ড।

এই বছরের শুরুর দিকে ফাঁস হওয়া কিছু নথিপত্র হাতে পেয়েছিল বিবিসি, যাতে উইঘুর মুসলমানদের গণধর্ষণ, যৌন নির্যাতন এবং অত্যাচারের ঘটনা উন্মোচিত হয়েছিল।’শিনজিয়ান পুলিশ ফাইল’ বলে অভিহিত ওই নথিপত্রগুলো বিবিসিতে পাঠানো হয়েছিল এবং উইঘুর সম্প্রদায়কে টার্গেট করার জন্য উচ্চ পর্যায় থেকে – স্বয়ং চীনা নেতা শি জিনপিং-এর পর্যায় থেকে – এই আদেশ এসেছিল এমন তথ্য উঠে এসেছে।

২০২০ সালে উইঘুরদের চোখ বেঁধে ট্রেনে নিয়ে যাওয়া হচ্ছে এমন একটি ভিডিও প্রকাশিত হওয়ার পর যুক্তরাজ্যের তৎকালীন পররাষ্ট্রমন্ত্রী ডমিনিক রাব চীনকে তার মুসলিম জনগোষ্ঠীর বিরুদ্ধে “গুরুতর এবং জঘন্য” মানবাধিকার লঙ্ঘনের জন্য অভিযুক্ত করেছিলেন।

ভিডিওটি প্রকাশিত হওয়ার পর আন্তর্জাতিক অঙ্গনে ব্যাপক ক্ষোভ তৈরি হয়। ওই সময় বিবিসির অ্যান্ড্রু মার শো-তে উপস্থিত হয়ে যুক্তরাজ্যে চীনের রাষ্ট্রদূত লিউ জিয়াওমিং জোর দিয়ে বলেছিলেন যে “শিনজিয়ানে এ রকম কোন কনসেন্ট্রেশন ক্যাম্প নেই”।

চীন কী বলছে?

চীন তার শিনজিয়ান প্রদেশে মানবাধিকার লঙ্ঘনের অভিযোগ সবসময় অস্বীকার করেছে।’শিনজিয়ান পুলিশ ফাইল’ সম্পর্কে প্রতিক্রিয়ায় চীনের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের মুখপাত্র বিবিসিকে বলেছিলেন যে এই নথিগুলি “চীন বিরোধী মত ও চীনকে ছোট করার যে চেষ্টা তার সর্বশেষ উদাহরণ”।

তিনি বলেন, শিনজিয়ানে স্থিতিশীলতা ও সমৃদ্ধি রয়েছে এবং সেখানকার বাসিন্দারা সুখী জীবনযাপন করছে।চীনের বক্তব্য হলো, সন্ত্রাসবাদ প্রতিরোধ এবং ইসলামী চরমপন্থার মূলোৎপাটনে শিনজিয়ানে অভিযান জরুরী এবং এই শিবিরগুলি সন্ত্রাসবাদের বিরুদ্ধে যুদ্ধের বন্দীদের সংস্কারের একটি কার্যকর হাতিয়ার।

চীন জোর দিয়ে বলে যে উইঘুর জঙ্গিরা একটি স্বাধীন রাষ্ট্রের বিরুদ্ধে হিংসাত্মক প্রচারণা চালাতে বোমা হামলা, নাশকতা এবং নাগরিক অস্থিরতার পরিকল্পনা করেছে। তবে উইঘুরদের দমনকে ন্যায্যতা দেওয়ার জন্য চীন এসব হুমকি অতিরঞ্জিত করে বলে অভিযোগ রয়েছে।

উইঘুর সম্প্রদায়ের জনসংখ্যা কমানোর জন্য তাদের উপর কৃত্রিম বন্ধ্যত্ব পদ্ধতি বলপূর্বক চাপিয়ে দেয়া হচ্ছে এমন অভিযোগকে চীন “ভিত্তিহীন” এবং “সম্পূর্ণ বানোয়াট” বলে উল্লেখ করেছে।

সূত্রঃবিবিসি

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *