০৫ অক্টোবর ২০২২, ২০ আশ্বিন ১৪২৯, ৮ রবিউল আওয়াল ১৪৪৪ হিজরি
বাংলাদেশ ব্যাংকের তথ্য অনুযায়ী,সেপ্টেম্বর মাসে যে প্রবাসী আয় এসেছে, তা গত সাত মাসের মধ্যে সর্বনিম্ন। এই মাসে রেমিট্যান্স এসেছে ১৫৩ কোটি ৯৫ লাখ ডলার।
গত বছরের সেপ্টেম্বর মাসের তুলনায় এই আয় কমেছে অন্তত ১০ শতাংশ।
দুটো ঈদ বা উৎসবের মৌসুমে বাংলাদেশে সাধারণত সবচেয়ে বেশি প্রবাসী আয় আসে। ওই সময় ছাড়া দেশটিতে গড়ে দুই বিলিয়ন বা দুইশো’ কোটি ডলারের রেমিট্যান্স আসে।
কিন্তু সেপ্টেম্বর মাসে এই খাতে আয় এতটা কমে যাওয়ার কারণ কি? গবেষণা প্রতিষ্ঠান সানেমের নির্বাহী পরিচালক ড. সেলিম রায়হান মনে করেন যে বেশ কিছুদিন ধরে প্রবাসী আয় কমে যাওয়ার ধারাবাহিকতায় এটা ঘটেছে।
বিবিসি বাংলাকে তিনি বলেন, ”আসলে রেমিট্যান্সের একটি নেতিবাচক প্রবণতা আমরা গত অর্থবছরেই দেখেছি। আগের বছরের তুলনায় গত বছর রেমিট্যান্স গত অর্থবছরে প্রায় ১৫ শতাংশ কমে গিয়েছিল। ফলে রেমিট্যান্সের ওপর নেতিবাচক প্রবৃদ্ধির ধারা থেকে আমরা বের হয়ে আসতে পারিনি।”
এর কারণ হিসাবে অর্থনীতিবিদরা বলছেন, বাংলাদেশের বাজারে ডলারের বিনিময় মূল্য নিয়ে অস্থিরতা, রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধের কারণে বিশ্ব জুড়েই অস্থিরতার প্রভাব পড়েছে রেমিট্যান্সের ওপরে।
তবে বাংলাদেশে প্রবাসী আয় কমতে থাকলেও গত মাসে ১০ শতাংশের বড় ধরণের নেতিবাচক প্রবৃদ্ধির পেছনে আরও কারণ আছে বলে ধারনা করছেন সেলিম রায়হান। তার মতে, মুদ্রা বিনিময় হারের ক্ষেত্রে বড় ধরনের ভারসাম্যহীনতা রেমিট্যান্স কমার পেছনে একটা বড় কারণ হতে পারে।
বিষয়টি ব্যাখ্যা করে তিনি বলেন যে খোলাবাজারের তুলনায় আনুষ্ঠানিক চ্যানেলে আসা রেমিট্যান্সের বিপরীতে কম টাকা পাওয়া যাচ্ছে, আর এই কারণেই হয়তো দেশে প্রবাসীদের আয় আসলেও তা বাংলাদেশ ব্যাংকের রেমিট্যান্সের হিসাবে যোগ হচ্ছে না।
অর্থাৎ তার মতে, ব্যাংকিং ব্যবস্থায় প্রবাসী আয়ের ক্ষেত্রে বিনিময় হার কম থাকার কারণে হয়তো বিদেশে বসবাসরত কর্মীরা দেশে অর্থ পাঠানোর জন্য আনুষ্ঠানিক ব্যাংকিং ব্যবস্থা ব্যবহার না করে হুন্ডি বা বিকল্প চ্যানেল ব্যবহার করছেন।
তার কথার প্রমাণ পাওয়া গেলো সৌদি আরব প্রবাসী জনি মিয়ার (তার আসল নাম ব্যবহার করা হয়নি) বক্তব্যে।
”দেশে তো প্রতি মাসেই টাকা পাঠাতে হয়। কিন্তু ব্যাংকে পাঠানো হলে পরিবার টাকা কম পায়। এখানে কিছু দোকান আছে। ওদের কাছে টাকা দিলে দিনের মধ্যেই পরিবার টাকা পায়, আবার টাকাও বেশি (ব্যাংকের চেয়ে) পাওয়া যায়।”
প্রবাসী এই বাংলাদেশি কর্মীর সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, সৌদি আরব, দুবাই, কাতার, বাহরাইন-সহ মধ্যপ্রাচ্যের দেশগুলোয় কর্মরত বাংলাদেশি প্রবাসীরা এতদিন ব্যাংকিং চ্যানেল ব্যবহার করে বাংলাদেশে টাকা পাঠাতেন। কারণ এক্ষেত্রে দুই শতাংশ প্রণোদনা যোগ হয়ে ভালো বিনিময় মূল্য পাওয়া যেতো।
কিন্তু গত কয়েক মাস ধরে ডলারের বিনিময় মূল্য অস্থিতিশীল হয়ে পড়ার পর হঠাৎ করে ডলারের দাম নির্ধারণ করে দেয়ার পর প্রবাসীদের অনেকেই ব্যাংকিং চ্যানেলের বাইরে গিয়ে দেশে টাকা পাঠাতে শুরু করেন।
গত ১২ই সেপ্টেম্বর থেকে অ্যাসোসিয়েশন অব ব্যাংকার্স বাংলাদেশ (এবিবি) এবং বাংলাদেশ ফরেন এক্সচেঞ্জ অথরাইজড ডিলারস অ্যাসোসিয়েশন যৌথভাবে ডলারের দাম নির্ধারণ করে দিচ্ছে।
বাংলাদেশ ব্যাংকের তথ্য অনুযায়ী, আন্তঃব্যাংক লেনদেনে সর্বশেষ ২রা অক্টোবর ডলার লেনদেন হয়েছে সর্বোচ্চ ১০৫ টাকা ২০ পয়সা হারে। রেমিট্যান্সের ক্ষেত্রে দেয়া হচ্ছে ১০৭ টাকা।
কিন্তু অনানুষ্ঠানিক বাজার বা কার্ব মার্কেটে বৈদেশিক লেনদেনের জন্য বহুল ব্যবহৃত মার্কিন এই মুদ্রা বিক্রি হচ্ছে এর চেয়ে বেশি দামে।
অর্থনীতিবিদ সেলিম রায়হান মনে করেন যে রেমিট্যান্স আয় এবং রপ্তানিখাতে উপার্জন নিয়ে উদ্বেগ এবং শঙ্কা বাড়তেই থাকবে যদি না এই দুটো ক্ষেত্রে ইতিবাচক পরিবর্তন আসে।
”আপনাদের হয়তো মনে আছে, এই অর্থবছরের শুরুর দিকে আমাদের বৈদেশিক লেনদেনের ভারসাম্যে বড় ধরনের চাপ পড়েছিল। সেটার একটা কারণ ছিল, রেমিট্যান্স আয় কমার ফলে আমাদের অর্থনীতিতে ফরেন কারেন্সির সরবরাহ কমে যাওয়া।”
”যেহেতু আমাদের অর্থনীতির দুটো বড় চালিকাশক্তি রেমিট্যান্স এবং রপ্তানি খাত – তার যে গতিপ্রকৃতি, তাতে বলা যায় আমাদের সামষ্টিক অর্থনীতিতে একটি বড় সঙ্কট চলছে। সেই সঙ্কট উত্তরণে এই দুটির সহায়ক ভূমিকা দেখা যাচ্ছে না। ফলে অবশ্যই উদ্বেগের জায়গা আছে। এই ধারা যদি অব্যাহত থাকে, তাহলে ফরেন রিজার্ভে আমাদের স্বস্তির জায়ড়া আরও কমতে থাকবে,” বলেন তিনি।
গত অর্থবছর অর্থাৎ ২০২১-২০২২ সালে বাংলাদেশে মোট প্রবাসী আয় এসেছে ২ হাজার ২০৩ কোটি ডলার। গড়ে প্রতি মাসে এসেছে ১৭৫ কোটি ডলার। সেই তুলনায় সেপ্টেম্বরে এসেছে দেড়শো’ কোটি ডলারের কিছু বেশি।
তবে বাংলাদেশ ব্যাংকের নির্বাহী পরিচালক ও মুখপাত্র মোহাম্মদ সিরাজুল ইসলামের মতে, রেমিট্যান্স আয় সেপ্টেম্বর মাসে তুলনামূলকভাবে কম হলেও সেটা নিয়ে এখনই উদ্বিগ্ন হওয়ার যথেষ্ঠ কারণ নেই।
”গত মাসে রেমিট্যান্স কিছুটা কম হলেও এটা মনে রাখতে হবে যে বিভিন্ন সময় এটা কম-বেশি হয়ে থাকে। বিশেষ করে বিভিন্ন উৎসবেরে সময় রেমিট্যান্স আয় বেশি হয়। জুলাই-অগাস্ট মাসেই দুই বিলিয়ন করে রেমিট্যান্স এসেছে,” বিবিসি বাংলাকে বলেন তিনি।
তবে রেমিট্যান্স কম আসার প্রবণতার বিষয়টি বিবেচনায় নিয়ে বাংলাদেশ ব্যাংক বিভিন্ন উদ্যোগ নিয়েছে বলে জানান কেন্দ্রীয় ব্যাংকের এই কর্মকর্তা।
তিনি বলেন, ”রেমিট্যান্স যাতে বৃদ্ধি করা যায়, সে জন্য বাইরের দেশগুলোয় রাষ্ট্রদূতদের বলা হয়েছে। আমাদের ব্যাংক, মন্ত্রণালয়ের লোকজন ভিজিট করছে। তারা যাতে ন্যূনতম ফর্মালিটি করে টাকা পাঠাতে পারে, সেসব ব্যবস্থা নেয়া হয়েছে।”
করোনাভাইরাস মহামারির সময় বাংলাদেশ থেকে বিদেশে কর্মসংস্থান কমে গেলেও সাম্প্রতিক সময়ে সেটি আবার বেড়েছে এবং এই প্রবণতা আরও বেশি বৈদেশিক মুদ্রা আয়ের ক্ষেত্রে একটি ইতিবাচক সম্ভাবনা তৈরি করেছে বলে মনে করেন অর্থনৈতিক বিশ্লেষকরা।
”শ্রমিকদের বাইরে যাওয়ার ক্ষেত্রে যে বিধিনিষেধ তৈরি হয়েছিল, আশার কথা হলো, সেখানে একটা গতি এসেছে। এখন অনেকে বাইরে যাচ্ছেন। কিন্তু তারা যাতে হুন্ডির মাধ্যমে টাকা না পাঠিয়ে ব্যাংকিং চ্যানেল ব্যবহার করে দেশে টাকা পাঠান, সেজন্য তাদের উদ্বুদ্ধ করতে হবে,” বলেন সেলিম রায়হান।
সূত্রঃবিবিসি