কৃষিমন্ত্রী এবং আওয়ামী লীগের প্রেসিডিয়াম সদস্য ড. মো: আব্দুর রাজ্জাক বলেছেন,ব্রয়লার মুরগির গোশত নিরাপদ খাদ্য এবং গোশত খাওয়ার ক্ষেত্রে জনস্বাস্থ্যের জন্য কোনো ঝুঁকি নেই।
তিনি আরো বলেন, উৎস নির্বিশেষে ব্রয়লারের গোশতে সর্বোচ্চ সহনশীল মাত্রার অনেক কম পরিমাণ অ্যান্টিবায়োটিক এবং ভারী ধাতুর অবশিষ্টাংশ রয়েছে।
ড. আব্দুর রাজ্জাক বৃহস্পতিবার (১২ জানুয়ারি) সচিবালয়ের তথ্য অধিদফতরের সম্মেলন কক্ষে কৃষি মন্ত্রণালয়ের অর্থায়নে বাংলাদেশ কৃষি গবেষণা কাউন্সিলের অধীনে করা এক গবেষণা ফলাফল জানাতে আয়োজিত এক সংবাদ সম্মেলনে এ কথা বলেন।
ব্রয়লার মুরগির গোশতে মানবস্বাস্থ্যের জন্য ক্ষতিকর অ্যান্টিবায়োটিক, হেভি মেটাল ও অন্যান্য ক্ষতির উপাদানের উপস্থিতি সম্পর্কে এ গবেষণা পরিচালনা করা হয়।
সংবাদ সম্মেলনে মৎস্য ও প্রাণিসম্পদমন্ত্রী শ ম রেজাউল করিম, কৃষি সচিব ওয়াহিদা আক্তার, মৎস্য ও প্রাণিসম্পদ সচিব ড. নাহিদা রশিদ, কৃষি গবেষণা কাউন্সিলের নির্বাহী চেয়ারম্যান ড. শেখ মোহাম্মদ বকতিয়ার ও প্রধান তথ্য কর্মকর্তা মো: শাহেনুর মিয়া, গবেষণার সাথে জড়িত গবেষণা প্রকল্পের মুখ্য বৈজ্ঞানিক কর্মকর্তা ড. মো: রফিকুল ইসলামসহ অন্য কর্মকর্তারা উপস্থিত ছিলেন।
‘ব্রয়লার মুরগির গোশত খাওয়া নিরাপদ কিনা’- এই বিষয়ে গত বছরের জানুয়ারি থেকে জুন পর্যন্ত গবেষণাটি পরিচালিত হয়।
ড. আব্দুর রাজ্জাক বলেন, ব্রয়লার মুরগির গোশত, হাড় ও কম্পোজিটে মূলত দুটি অ্যান্টিবায়োটিক (অক্সিটেট্রাসিাইক্লিন ও ডক্সিসাইক্লিন) এবং তিনটি হেভি মেটালের (আর্সেনিক, ক্রোমিয়াম ও লেড) সামান্য উপস্থিতি রয়েছে, যা অস্বাভাবিক নয়। আর তা সর্বোচ্চ সহনশীল সীমার অনেক নিচে।
তিনি বলেন, খামার ও বাজারে প্রাপ্ত ব্রয়লার গোশতের চেয়ে সুপারশপের ব্রয়লার গোশতে অ্যান্টিবায়োটিক এবং হেভি মেটালের পরিমাণ কম রয়েছে।
কৃষিমন্ত্রী বলেন, ব্রয়লার মুরগির গোশত খাওয়া নিরাপদ কিনা- এ নিয়ে আমাদের অনেকের মধ্যেই ভ্রান্ত ধারণা বা দ্বিধাদ্বন্দ্ব রয়েছে। বিভিন্ন পত্রপত্রিকায় এবং সোশ্যাল মিডিয়ায় অনেক প্রচারণায় বিভ্রান্তিমূলক তথ্যের ফলে সাধারণ জনগণের মধ্যে অনেক সময় ব্রয়লার গোশত সম্পর্কে ভ্রান্ত ধারণা ছড়িয়ে পড়ে। এতে ব্রয়লার শিল্পের উপর একটি বড় ধরনের ক্ষতিকর প্রভাব পড়ে।
তিনি বলেন, গবেষণায় বাংলাদেশের পাঁচটি জেলা শহরের (ঢাকা, গাজীপুর, চট্টগ্রাম, রাজশাহী এবং বরিশাল) ব্রয়লার খামার (ছোট, মাঝারি ও বড়) এবং বাজার থেকে ব্রয়লারের গোশত, হাড় ও কম্পোজিট এবং ব্রয়লার খাদ্যের নমুনা সংগ্রহ করা হয়। পাশাপাশি ঢাকা জেলার তিনটি সুপার শপ থেকে ব্রয়লার মুরগির নমুনা সংগ্রহ করা হয়। সংগৃহীত প্রায় ১২০০টি ব্রয়লার মুরগি এবং ৩০টি ব্রয়লার মুরগির খাদ্য থেকে ৩১৫টি নমুনা প্রস্তুত করে বহুল ব্যবহৃত ১০টি অ্যান্টিবায়োটিক এবং ৩টি ভারী ধাতুর অবশিষ্টাংশের পরিমাণ পরীক্ষা করা হয়।
মন্ত্রী বলেন, দশটি অ্যান্টিবায়োটিকের মধ্যে সাতটি অ্যান্টিবায়োটিক (এনরোফ্লক্সাসিন, সিপরোফ্লক্সাসিন, নিওমাইসিন, টাইলোসিন, কলিস্টিন, এমোক্সাসিলিন এবং সালফাডায়াজিন) পরীক্ষণের জন্য নমুনাসমূহ এসজিএস বাংলাদেশ লিমিটেডের মাধ্যমে ভারতের চেন্নাইয়ের এসজিএস ল্যারোটরিতে পাঠানো হয়। বাকি তিনটি অ্যান্টিবায়োটিক (ক্লোরামফেনিকল, অক্সিটেট্রাসাইক্লিন ও ডক্সিসাইক্লিন) এবং তিনটি ভারী ধাতু (আর্সেনিক, ক্রোমিয়াম ও লেড) পরীক্ষণের জন্য নমুনাসমূহ প্রাণিসম্পদ অধিদফতরের অধীন আধুনিক উন্নত যন্ত্রপাতি ও প্রযুক্তিসমৃদ্ধ আইএসও সনদপ্রাপ্ত ও স্বীকৃত ঢাকার সাভারের কোয়ালিটি কন্ট্রোল ল্যাবরেটরিতে হয়।
গবেষণায় প্রাপ্ত ফলাফল বিস্তারিত তুলে ধরে কৃষিমন্ত্রী বলেন, ব্রয়লার গোশতে গড়ে ৮ পিপিবি (পার্টস পার বিলিয়ন) অক্সিটেট্রাসাইক্লিন, ৯ দশমিক ১ পিপিবি ডক্সিসাইক্লিন, ৬ দশমিক ২ পিপিবি আর্সেনিক, ১৯০ দশমিক ৭ পিপিবি ক্রোমিয়াম এবং ২৫৯ দশমিক ১ পিপিবি লেড রয়েছে, যা সর্বোচ্চ সহনশীল অথবা অবশিষ্ট সীমার চেয়ে যথাক্রমে ১২ দশমিক ৫ গুণ, ১০ দশমিক ৯ গুণ, ৬ দশমিক ৫ গুণ, ৫ দশমিক ২ গুণ এবং ২৩ দশমিক ১ গুণ নিচে রয়েছে।
মন্ত্রী বলেন, ব্রয়লার মুরগির হাড়ের নমুনা পরীক্ষণের ফলাফলে দেখা যায়, গড়ে ৫৩ দশমিক ৭ পিপিবি অক্সিটেট্রাসাইক্লিন, ২৭ দশমিক ০ পিপিবি ডক্সিসাইক্লিন, ৭ দশমিক ২ পিপিবি আর্সেনিক, ৪৩৯ দশমিক ৯ পিপিবি ক্রোমিয়াম এবং ৪৬৪ দশমিক ৬ পিপিবি লেড রয়েছে, যা সর্বোচ্চ অবশিষ্ট সীমার চেয়ে যথাক্রমে ১ দশমিক ৮ গুণ, ৩ দশমিক ৭ গুণ, ৫ দশমিক ৫ গুণ, ২ দশমিক ২৭ গুণ এবং ১২ দশমিক ৯ গুণ নিচে রয়েছে।
ব্রয়লার মুরগির কম্পোজিটে (কলিজা, কিডনি ও গিজার্ডের সমন্বয়) গড়ে ১৪ দশমিক ৫ পিপিবি অক্সিটেট্রাসাইক্লিন, ১৭ দশমিক ২ পিপিবি ডক্সিসাইক্লিন, ১০ দশমিক ৯ পিপিবি আর্সেনিক, ২৩৯ দশমিক ২ পিপিবি ক্রোমিয়াম এবং ৩০৭ দশমিক ৬ পিপিবি লেড রয়েছে, যা সর্বোচ্চ অবশিষ্ট সীমার চেয়ে যথাক্রমে ৬ দশমিক ৮ গুণ, ৫ দশমিক ৮ গুণ, ৩ দশমিক ৬ গুণ, ৪ দশমিক ১৮ গুণ এবং ১৯ দশমিক ৫ গুণ নিচে রয়েছে বলেও জানান কৃষিমন্ত্রী।
তিনি জানান, বাজার এবং খামার থেকে সংগৃহীত ব্রয়লার মুরগির খাদ্যে গড়ে দশমিক ৮ পিপিবি অক্সিটেট্রাসাইক্লিন, ১৯ দশমিক ২ পিপিবি ডক্সিসাইক্লিন, ৪ দশমিক ১৯ পিপিবি টাইলোসিন, ৭ দশমিক ৬ পিপিবি আর্সেনিক, ২১৫৩ দশমিক ৩ পিপিবি ক্রোমিয়াম এবং ৪৭৮ দশমিক ৬ পিপিবি লেড রয়েছে, যা আর্সেনিকের ক্ষেত্রে ১৮৪ দশমিক ২ গুণ, ক্রোমিয়ামের ক্ষেত্রে ৯ দশমিক ২ গুণ এবং লেডের ক্ষেত্রে ২০ দশমিক ৮ গুণ সর্বোচ্চ অবশিষ্ট সীমার চেয়ে নিচে রয়েছে।
মন্ত্রী জানান, মুরগির খাবারে ট্যানারির বর্জ্য ব্যবহার করার বিষয়টিও সম্পূর্ণ ভিত্তিহীন। দেশে বর্তমানে হাঁস বা মুরগির খাবারের চাহিদার পরিমাণ ৯৫ লাখ টন, গবাদিপশুর ১৪৫ লাখ টন, অথচ মোট ট্যানারির বর্জ্য হয় মাত্র ৮৫ হাজার টন।
মন্ত্রী আরো জানান, তুলনামূলকভাবে সারা পৃথিবীতে বাণিজ্যিক ভিত্তিতে উৎপাদিত উন্নত জাতের মুরগির গোশত আমিষসমৃদ্ধ ও সস্তা। অনেক উচ্চবিত্তরা মনে করে, এটা গরীবের গোশত। তথাকথিত অনেক অভিজাত শ্রেণী অহংকার করে বলে, আমরা ফার্মের মুরগি খাই না। অথচ উন্নত বিশ্বের সকল শ্রেণী-পেশার মানুষ সবচেয়ে বেশি আমিষ গ্রহণ করে বাণিজ্যিক ভিত্তিতে উৎপাদিত উন্নত জাতের মুরগির গোশত থেকে।
সূত্র : বাসস