তাজমহলের তালাবন্ধ ঘরগুলোতে সত্যিই কি কোনো রহস্য লুকিয়ে রয়েছে?
ভারতের একটি হাইকোর্টের বিচারকরা তা মনে করেননি। সে কারণেই তারা ক্ষমতাসীন হিন্দু জাতীয়তাবাদী বিজেপির একজন স্থানীয় পর্যায়ের নেতার আনা একটি অবেদন খারিজ করে দিয়েছেন।
রাজেশ সিং তার আবেদনে দাবি করেন তাজমহলের ২০টিরও বেশি “স্থায়ীভাবে তালাবন্ধ” কক্ষগুলো খুলে দেওয়া হোক যাতে “এই সৌধের প্রকৃত ইতিহাস” বেরিয়ে আসে।
মি. সিং খুব পরিষ্কারভাবেই আদালতকে বলেন, তিনি দেখতে চান তাজমহলের ভেতরের তালা দেওয়া ঘরগুলোতে হিন্দু দেবতা শিবের একটি মন্দির রয়েছে বলে যে “দাবি ঐতিহাসিকরা এবং ভক্তরা করেন” – তা যথার্থ কিনা।বিজ্
আগ্রায় যমুনা নদীর তীরে অসামান্য সুন্দর এই সৌধটি তৈরি হয়েছিল সপ্তদশ শতাব্দীতে। মোগল সম্রাট শাহজাহান তার মৃত স্ত্রী মমতাজের স্মৃতি ধরে রাখতে তাজমহল তৈরি করেছিলেন।
ইট, লাল রংয়ের পাথর এবং সাদা মার্বেলের তৈরি এই সৌধটি জুড়ে সূক্ষ্ম কারুকার্য আর শিল্পকলা সারা পৃথিবীর মানুষকে মুগ্ধ করেছে। তাজমহল শুধু ভারত নয়, সারা বিশ্বের মধ্যেই পর্যটনের অন্যতম প্রধান একটি আকর্ষণ।
কিন্তু তাজমহল নিয়ে প্রতিষ্ঠিত ইতিহাসে সন্তুষ্ট নন বিজেপির রাজেশ সিং। “বন্ধ দরজাগুলোর ওপাশে কী আছে তা আমাদের জানা উচিৎ,” আদালতে বলেন তিনি।
তাজমহল কি কখনো হিন্দু মন্দির ছিল?
‘তাজমহল ভারতীয় সংস্কৃতির কলঙ্ক’
‘তাজমহল রক্ষণাবেক্ষণে ব্যর্থ ভারত সরকার’
তালা দেওয়া যে কক্ষগুলোর কথা মি. সিং তুলছেন সেগুলোর অধিকাংশই সৌধের ভূগর্ভস্থ অংশে অবস্থিত। এবং তাজমহলের ব্যাপারে সবচেয়ে বেশি জ্ঞান রাখেন এমন অনেক মানুষের মতে, ভূগর্ভস্থ ঐ ঘরগুলোর ভেতর আদৌ কোনো রহস্য নেই।
কক্ষগুলো নিয়ে এক গবেষকের বয়ান
মোগল স্থাপত্যের একজন শীর্ষ বিশেষজ্ঞ এবা কোচ, যিনি তাজমহলের ওপর গবেষণাধর্মী একটি বই লিখেছেন, তার গবেষণার সময় ঐ সমস্ত কক্ষ এবং ভেতরের সমস্ত প্যাসেজ বা পথের ভেতর ঢুকে খুঁটিয়ে দেখেছেন এবং ছবি তুলেছেন।
তিনি লিখেছেন, তাজমহলের নিচে ভূগর্ভস্থ ঐ কক্ষগুলো তৈরি করা হয়েছিল ‘তাহখানা’র অংশ হিসাবে। মোগলরা গরমের মাসগুলোতে শরীর শীতল রাখতে এমন ভূগর্ভস্থ কক্ষ তৈরি করতো।
সৌধের নিচে নদীমুখী একটি চত্বরে সারিবদ্ধ বেশ কয়েকটি কক্ষ রয়েছে। মিজ কোচ নদীর সমান্তরাল এরকম ১৫টি কক্ষের কথা লিখেছেন। সরু একটি করিডোর দিয়ে ঐ চত্বরে যাওয়া যায়।
এগুলোর মধ্যে সাতটি কক্ষ বেশ বড় – যেগুলোর প্রতিটির দুই দেয়ালে বর্ধিত অংশ রয়েছে। ছয়টি কক্ষ চার দেয়ালের এবং দুটি কক্ষে দেয়ালের সংখ্যা আটটি করে।
বড় আকৃতির কক্ষগুলোর সামনে রয়েছে কারুকার্য খচিত খিলান বা তোরণ – যেগুলোর ভেতর দিয়ে যমুনা দেখা যায়।
ঘরগুলোর সাদা চুনকাম করা দেয়ালের নিচে মিজ কোচ “রঙিন কারুকার্যের” নমুনা দেখেছেন।
“এটা নিশ্চিত যে সম্রাট যখন এই সৌধে আসতেন তখন এসব প্রশস্ত, সুন্দর এবং শীতল কক্ষগুলো ছিল তার, সহযোগীদের এবং তার নারীদের আদর্শ বিশ্রামের জায়গা,” লিখেছেন মিজ কোচ যিনি ভিয়েনা বিশ্ববিদ্যালয়ের এশিয়ান আর্টস বিভাগের একজন অধ্যাপক।
এধরণের ভূগর্ভস্থ গ্যালারি মোগল স্থাপত্যের অংশ ছিল। পাকিস্তানের লাহোরে মোগলদের একটি দুর্গে জলাধারের সমান্তরাল এমন সার দেওয়া ভূগর্ভস্থ কক্ষ রয়েছে।
সম্রাট শাহজাহান অনেকসময় যমুনা নদী দিয়ে নৌকায় করে তাজমহলের আসতেন। অনেক সিঁড়িবাধা একটি ঘাটে নেমে তাজমহলে ঢুকতেন তিনি।
ভারতীয় প্রত্নতত্ত্ব সংরক্ষক অমিতা বেগ যিনি ২০ বছর আগে তাজমহলের ভূগর্ভস্থ ঐ অংশে ঢুকেছিলেন। তিনি পরে লেখেন, “সেখানে গিয়ে চমৎকার কারুকার্যে মোড়া একটি করিডোর দেখেছিলাম। ঐ করিডোর দিয়ে প্রশস্ত একটি চত্বরে যেতে হয়। পরিষ্কার বোঝা যায় সম্রাট এই করিডোর দিয়ে ঢুকতেন”।
দিল্লিতে ইতিহাসবিদ রানা সাফাভি, যিনি আগ্রায় বড় হয়েছেন – বলেন ১৯৭৮ সালে এক বন্যার আগ পর্যন্ত তাজমহলের ভূগর্ভস্থ ঐ অংশে পর্যটকরা যেতে পারতেন।
“বন্যার পানি তাজমহলের ভেতর ঢুকে গিয়েছিল, পানি নামার পর মাটির নিচের ঐ ঘরগুলোর মেঝেতে পলির আস্তরণ পড়েছিল। দেয়ালে, মেঝেতে ফাটল দেখা দিয়েছিল। তারপরই কর্তৃপক্ষ জনসাধারণের জন্য ঘরগুলোতে ঢোকা বন্ধ করে দেয়। ওগুলোর ভেতর কিছুই নেই।, ” বলেন মিজ সাফাভি।
শুধু মাঝেমধ্যে সংস্কার কাজের জন্য ঘরগুলো খোলা হয়।
তাজমহল ঘিরে যেসব গল্প-জনশ্রুতি
অন্য অনেক পুরনো সৌধের মত তাজমহলকে ঘিরেও অনেক গল্প, জনশ্রুতি রয়েছে।
যেমন, কথিত রয়েছে যে শাহজাহান মূল তাজমহলের ঠিক উল্টোদিকে একটি “কালোরঙা তাজমহল” বানাতে চেয়েছিলেন। এমন বিশ্বাস রয়েছে তাজমহলের স্থপতি ছিলেন একজন ইউরোপীয়।
অনেক পশ্চিমা বুদ্ধিজীবী বিভিন্ন সময় বলেছেন যে মুসলিম সমাজে নারীদের যে নিচু অবস্থান ছিল তাতে এটা অসম্ভব যে শাহজাহান তার মৃত স্ত্রীর স্মৃতির প্রতি সম্মান দেখাতে তাজমহল তৈরি করেছিলেন।
তাজমহলে ঢোকার দরজার কাছে এমন অনেক অতি উৎসাহী গাইড রয়েছেন যারা পর্যটকদের গল্প বলেন তাজমহলের কাজ শেষ হওয়ার পর কিভাবে শাহজাহান প্রধান স্থপতি এবং আরো অনেক কর্মী এবং কারু শিল্পীকে হত্যা করেছিলেন।
ভারতে, অনেকদিন ধরে একটি কল্পকথা চলে আসছে যে তাজ আসলে একটি হিন্দু মন্দির ছিল। দেবতা শিবের নামে মন্দিরটি তৈরি হয়েছিল।
পি এন ওক – যিনি ১৯৬৪ সালে ভারতের ইতিহাস নতুন করে রচনার জন্য একটি ইন্সটিটিউট প্রতিষ্ঠা করেছিলেন – তার এই বইতে লিখেছেন, তাজমহল সন্দেহাতীতভাবেই একটি শিব মন্দির ছিল।
২০১৭ সালে বিজেপির এক নেতা সাংগিত সোম বলেন তাজমহল ভারতের ইতিহাসের “একটি কলঙ্ক” কারণ, তার মতে, “বিশ্বাসঘাতকরা ছিল এর নির্মাতা।”
এ সপ্তাহেই বিজেপির একজন এমপি দিয়া কুমারি বলেন, শাহজাহান হিন্দু একটি রাজপরিবারের জমি দখল করে তাজমহল বানিয়েছিলেন।
ঐতিহাসিক মিজ সাফাভি বলেন গত এক দশকে এসব কল্পকথা আর গুজবের তত্ত্ব নতুন করে কট্টর হিন্দুদের একটি অংশের মধ্যে প্রাণ পেয়েছে। “কট্টরপন্থী এই অংশটি ভুয়া খবর, ভুয়া ইতিহাস এবং হিন্দুদের ওপর কল্পিত নিপীড়ন অবিচারের তত্ত্বে মশগুল।”
মিজ কোচও লিখেছেন,”তাজমহলকে নিয়ে যতটা পাণ্ডিত্যপূর্ণ গবেষণা হয়েছে তার চেয়ে অনেক বেশি হয়েছে কল্পকথার চর্চা।”