উৎপাদন ব্যয় বাড়ল ৬০ ভাগ
- বিশেষ প্রতিনিধি
- ১৩ জুন ২০২২, ০০:০০
দেশের সংবাদপত্র শিল্পের প্রধান কাঁচামাল নিউজপ্রিন্টের দাম লাফিয়ে লাফিয়ে বাড়ছে। মাত্র এক বছরের ব্যবধানে নিউজপ্রিন্টের দাম বেড়েছে শতভাগেরও বেশি। গত বছর জুনে যেখানে প্রতি টন নিউজপ্রিন্ট গড়ে ৪৩ হাজার টাকায় বিক্রি হতো, এবারের জুনে তা বেড়ে হয়েছে মিলভেদে ৮৬ হাজার থেকে ৯৬ হাজার টাকা পর্যন্ত। আরো কত বাড়বে তারও কোনো সদুত্তর নেই মিলারদের কাছে। এ দিকে সংবাদপত্র শিল্পের প্রধান কাঁচামাল নিউজপ্রিন্টের দাম অস্বাভাবিকভাবে বেড়ে যাওয়ায় অস্তিত্বের হুমকির মুখে পড়েছে এ শিল্প। সংশ্লিষ্টরা জানিয়েছেন, করোনাভাইরাসের প্রাদুর্ভাবের কারণে এক দিকে এ শিল্পের অন্যতম আয়ের খাত বিজ্ঞাপন থেকে রাজস্ব আয় অর্ধেকে নেমে গেছে, এর ওপর নিউজপ্রিন্টের দাম অস্বাভাবিক হারে বেড়ে যাওয়ায় এ শিল্প টিকিয়ে রাখাই কঠিন হয়ে পড়েছে। ইতোমধ্যে অর্থসঙ্কটে অনেক পত্রিকার কলেবর ছোট হয়ে এসেছে। ছোটখাটো অনেক পত্রিকা ছাপানো অনিয়মিত হয়ে পড়েছে।
নিউজপ্রিন্টের বাজার মূল্যের পরিসংখ্যান থেকে দেখা যায়, গত বছরের জুনে মধ্য মানের প্রতি টন নিউজপ্রিন্টের দাম ছিল ৪৩ হাজার টাকা। গত ডিসেম্বরে তা বেড়ে হয় ৫১ হাজার টাকা। আর ডিসেম্বরের পর নিউজপ্রিন্টের দাম লাফিয়ে লাফিয়ে বাড়তে থাকে। তিন মাসের ব্যবধানে মার্চে এসে প্রতি টন নিউজপ্রিন্টের দাম বেড়ে হয় ৫৬ হাজার টাকা। এর পর নিউজপ্রিন্টের মূল্যের পাগলা ঘোড়া ছুটতে থাকে। এপ্রিলেই আগের মাসের চেয়ে প্রতি টনে ১০ হাজার টাকা বেড়ে হয় ৬৬ হাজার টাকা, মে মাসেও একই দাম থাকে। কিন্তু চলতি ১১ জুনে প্রতি টনপ্রতি গড়ে ২০ হাজার টাকা বেড়ে হয়েছে ৮৬ হাজার টাকা থেকে ৯৬ হাজার টাকা। নিউজপ্রিন্টের দাম এক বছরের ব্যবধানে বেড়েছে শতভাগের ওপরে। আর ১১ দিনের ব্যবধানে বেড়েছে ৩৩ শতাংশেরও ওপরে।
নিউজপ্রিন্ট দাম আরো কী পরিমাণ বাড়বে তার কোনো সদুত্তর নেই মিলারদের কাছে। গতকাল একটি কাগজের মিলের দায়িত্বশীল এক কর্মকর্তা জানিয়েছেন, নিউজপ্রিন্টের দাম কোথায় গিয়ে ঠেকবে তা এখনই বলা যাচ্ছে না। আগামী কয়েক দিনের মধ্যেই তা এক লাখ টাকা ছেড়ে যেতে পারে। কারণ, কাঁচামাল সঙ্কটের পাশাপাাশি একসাথে চাহিদা অস্বাভাবিক হারে বেড়ে গেছে। করোনার কারণে স্কুল বন্ধ থাকায় গত দুই বছরে নতুন বই, গাইড ছাপাতে হয়নি। কিন্তু করোনার প্রাদুর্ভাব কেটে যাওয়ায় নতুন উদ্যমে স্কুল-কলেজে ক্লাস শুরু হয়েছে। এর ফলে নতুন বই ছাপাতে কাগজের চাহিদা বেড়ে গেছে। একই সাথে আমের কার্টুনে নিউজপ্রিন্ট ব্যবহার বেড়ে গেছে। সেই সাথে তাঁত শিল্পেও নতুন নিউজপ্রিন্ট ব্যবহার বেড়ে গেছে।
নতুন শাড়ি, কাপড়ে আগে যেখানে পুরনো পত্রিকা ব্যবহার হতো, এখন সেখানে বেশির ভাগক্ষেত্রেই নতুন নিউজপ্রিন্ট ব্যবহার হচ্ছে। এভাবে নিউজপ্রিন্টের চাহিদা বেড়ে গেছে। কিন্তু যে হারে নিউজপ্রিন্টের চাহিদা বাড়ছে ওই হারে উৎপাদন হচ্ছে না। এর সরাসরি প্রভাব পড়ছে দেশের সংবাদপত্র শিল্পে।
এ দিকে নিউজপ্রিন্টের দাম বেড়ে যাওয়ার পাশাপাশি ২০ থেকে ৩০ শতাংশ হারে সংবাদপত্র শিল্পের অন্যান্য উপকরণ যেমন কালি, প্লেট ইত্যাদির দাম বেড়েছে। এর ফলে সংবাদপত্রের উৎপাদন ব্যয় অস্বাভাবিক হারে বেড়ে গেছে। এ ব্যয় বেশিরভাগ পত্রিকায়ই বহন করতে হিমশিম খাচ্ছে। অনেক পত্রিকাই অর্থ সঙ্কটে এর কলেবর অর্ধেকে নামিয়ে এনেছে। আগে যেখানে প্রতিদিন ২০ পৃষ্ঠা ছাপা হতো, এখন তা ১২ থেকে ১৬ পৃষ্টায় নামিয়ে আনা হয়েছে। শুধু ছাপানোর কলেবরই কমানো হয়নি, পত্রিকা শিল্পের সাথে জড়িত সাংবাদিক, কর্মকর্তা, কর্মচারীর বেতনভাতাতেও টান পড়েছে। অনেক পত্রিকার জনবলের বেতনভাতা বকেয়া পড়ে গেছে। সবমিলেই এ শিল্প সামনে এগুনো কঠিন চ্যালেঞ্জের মুখে পড়েছে।
একটি পত্রিকার একজন নির্বাহী জানিয়েছেন, করোনাভাইরাসের প্রাদুর্ভাবের কারণে সংবাদপত্র শিল্পের প্রধান আয়ের খাত বিজ্ঞাপন থেকে আয় অর্ধেকে নেমে গেছে। কারণ, দেশের অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ডের সাথে বিজ্ঞাপন আয় জড়িত। অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ড বাড়লেও নতুন বিনিয়োগ বৃদ্ধি পেলে নতুন নতুন শিল্পকারখানা গড়ে উঠে। আর এ শিল্পের পণ্যের পরিচিতি ও বিক্রি বাড়াতে শিল্পোদ্যোক্তারা পত্রিকা, টিভিতে বিজ্ঞাপন দিয়ে থাকে। কিন্তু করোনার প্রাদুর্ভাব ও চলমান পরিস্থিতির কারণ বিনিয়োগ কাক্সিক্ষত হারে হচ্ছে না। আর এ কারণে বিজ্ঞাপন থেকে আয় অস্বাভাবিক হারে কমে গেছে। সেই সাথে নিত্যপণ্যের দাম অস্বাভাবিক হারে বেড়ে যাওয়ায় জীবনযাত্রার ব্যয় বেড়ে গেছে। আর এ কারণে পত্রিকা বিক্রিও কমে গেছে। সবমিলেই সংবাদপত্রে শিল্পের আকাশে কালো মেঘের ছায়া পড়েছে। সংশ্লিষ্টরা জানিয়েছেন, এ থেকে উত্তোরণের একমাত্র পথ হলো সরকারি পষ্ঠপোষকতা বাড়ানো। সেই সাথে পত্রিকার উৎপাদন ব্যয় বৃদ্ধির সাথে এর মূল্য সমন্বয় করা। অন্যথায় এ শিল্প টিকে রাখাই কঠিন হয়ে পড়বে বলে তারা আশঙ্কা করেন।
নিউজপ্রিন্টের এই সঙ্কটের শুরুটা হয় আন্তর্জাতিক পরিস্থিতির কারণে। কোভিড পরিস্থিতির পর রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধেও প্রভাবে বিশ্ব বাজারে নিউজপ্রিন্টের দাম দ্বিগুণেরও বেশি হয়েছে। কোভিড-১৯ এবং রাশিয়ার ইউক্রেণ যুদ্ধেও মিলিত প্রভাবে ২০১৭ সালের ২৩.৮ মিলিয়ন টন নিউজপ্রিন্ট উৎপাদন ২০২২ সালে ১৩.৬ মিলিয়ন টনে নেমে এসেছে। এতে বিশ্ব বাজারে নিউজপ্রিন্টের এক টনের দাম ৫৭০ মার্কিন ডলার থেকে বেড়ে ১ হাজার ৫০ ডলার হয়েছে দেড় বছরে। সাধারণভাবে একটি সংবাদপত্র ছাপার মোট খরচের প্রায় ৫০ শতাংশ খরচ হয় নিউজপ্রিন্টে। সংবাদপত্র ছাপার কালি এবং অ্যালুমিনিয়াম প্লেটের দামও বাড়ছে। এতে সংবাদপত্রের উৎপাদন খরচ গড়ে ৬০ থেকে ৭০ শতাংশ বেড়ে গেছে।
বিদেশী নিউজপ্রিন্টের দাম বৃদ্ধির সুবাদে দেশি নিউজপ্রিন্টের দাম তার চেয়ে বেশি হারে বাড়ানো হয়েছে। বিদেশী নিউজপ্রিন্টের তুলনায় দেশী নিউজপ্রিন্টের মান অনেক নিচে হলেও বিদেশী নিউজপ্রিন্টের সাথে পাল্লা দিয়ে বাড়ানো হয়েছে দেশী নিউজপ্রিন্টের দাম। স্থানীয় নিউজপ্রিন্টে ছাপার মান কম হওয়া ছাড়াও বিদেশী নিউজপ্রিন্টের তুলনায় একই ওজনে ১০ থেকে ১৫ শতাংশ কম সংবাদপত্র উৎপাদন হয়। এরপরও এক বছর আগের তুলনায় স্থানীয় নিউজপ্রিন্টর দাম সোয়া শতভাগ বেড়ে প্রতি টন ৯০ হাজার টাকা ছাড়িয়ে গেছে। নিউজপ্রিন্টের দাম বেড়ে যাওয়ায় সার্বিক ব্যয়ও বেড়েছে। এর মধ্যে আবার আছে নানা ধরনের করের বোঝা। আবার সংবাদপত্রকে সেবাশিল্প হিসেবে ঘোষণা করা হলেও শিল্পের সুবিধা পাচ্ছে না এ খাত।
২০১৪ সালে শিল্প মন্ত্রণালয় সংবাদপত্রকে সেবাশিল্প হিসেবে ঘোষণা করেছে। কিন্তু বাংলাদেশে এখন সংবাদপত্র একটি রুগ্ণ শিল্পে পরিণত হয়েছে। সেবা শিল্প ও রুগ্ণ শিল্প হিসেবে সরকারের কাছ থেকে কোনো রকমের সুবিধা-সহযোগিতা পাওয়া যায়নি। এমনকি করোনাকাল এবং করোনাপরবর্তী সময়ে যেখানে বিভিন্ন শিল্পকে নানা ধরনের প্রণোদনা দেয়া হয়েছে, সেখানে সংবাদপত্রকে সহায়তা করা হয়নি বা চেষ্টাও হয়নি।
সংবাদপত্রের মালিকদের সংগঠন নোয়াব বাজেট ঘোষণার আগে সংবাদপত্রের বিদ্যমান সঙ্কট মোকাবেলায় বিভিন্ন ধরনের আরোপিত কর প্রত্যাহার বা কমানোর দাবি জানায়। কিন্তু বাজেটে এ বিষয়ে কোনো সাড়া দেখা যায়নি। সংবাদপত্রের ওপর আরোপিত করপোরেট কর এখন ৩০ শতাংশ। অথচ সংবাদপত্রের মতো রুগ্ণ শিল্পের ওপর কর ১০ শতাংশের বেশি হওয়ার কথা নয়। সংবাদপত্রের প্রধান কাঁচামাল নিউজপ্রিন্ট। কিন্তু কাস্টমস প্রসিডিউর কোড তালিকায় অন্তর্ভুক্ত থাকায় নিউজপ্রিন্টের আমদানির ওপর ১৫ শতাংশ ভ্যাট দিতে হচ্ছে। অন্য দিকে নিউজপ্রিন্টের ওপর বর্তমানে ৫ শতাংশ আমদানি শুল্ক দিতে হচ্ছে। এর সাথে মূল্য সংযোজন কর (১৫ শতাংশ) এবং অগ্রিম আয়করসহ (৫ শতাংশ) সব মিলিয়ে কর দিতে হয় প্রায় ২৭ শতাংশ। আবার সংবাদপত্রের বিজ্ঞাপন আয়ের ওপর উৎসে কর (টিডিএস) রয়েছে ৪ শতাংশ।
সব মিলিয়ে বাংলাদেশের সংবাদপত্র শিল্প এক নজিরবিহীন সঙ্কটকাল অতিক্রম করছে।