বাংলাদেশে যেখানে প্রতিনিয়ত নিত্যপণ্যের দাম বাড়ছে, এখন সেই খরচের খাতায় যুক্ত হতে পারে এক জেলা সাথে আরেক জেলার সংযোগের আঞ্চলিক মহাসড়কের টোলও।
প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা মঙ্গলবার একনেক সভায় এমন আভাস দিয়েছেন।
তিনি আঞ্চলিক মহাসড়ক থেকে টোল আদায়ের জন্য প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নিতে সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষকে নির্দেশ দিয়েছেন।
একনেকের সভায় তিনি বলেছেন, ‘সরকার হাজার হাজার কোটি টাকা খরচ করে অবকাঠামো নির্মাণ করছে। তাই আঞ্চলিক মহাসড়কে ন্যূনতম হারে হলেও টোল আদায়ের ব্যবস্থা করতে হবে। এতে মানুষের মধ্যে টোল দেয়ার সংস্কৃতিও গড়ে উঠবে।’
বিষয়টি পরিকল্পনার একদম প্রাথমিক স্তরে রয়েছে বলে জানিয়েছেন পরিকল্পনামন্ত্রী এম এ মান্নান।
তবে সরকার যেসব সড়কের উন্নয়নে প্রচুর বিনিয়োগ করছে সেখানে টোল আদায়ের এই পরিকল্পনাকে যৌক্তিক বলে তিনি মনে করছেন।
বিবিসি বাংলাকে তিনি বলেন, ’এই আঞ্চলিক সড়কগুলো চার লেনে উন্নীত করা হয়েছে, চওড়া করা হয়েছে, যোগাযোগ দ্রুতগামী হয়েছে। সেবা পেলে সেটার মূল্য দিতে হবে। বিনা পয়সায় সেবা তো চিরকাল দেয়া সম্ভব না। আমরা মানুষকে এই ধারণার সাথে পরিচিত করাতে চাই।’
যদিও বিশেষজ্ঞরা এই পরিকল্পনাকে সম্পূর্ণ অযৌক্তিক দাবি করে বলছেন, সড়কগুলোয় টোল বসালে পুরো সড়ক পরিকল্পনায় বিশৃঙ্খলার সৃষ্টি হবে।
এক্ষেত্রে সুষ্ঠু ব্যবস্থাপনা ও নীতিমালা পরিবর্তনে জোর দেন তারা।
আঞ্চলিক সড়কে টোল কেন
সড়ক ও জনপথ অধিদফতরের আওতায় বাংলাদেশে মোট ৯৯২টি সড়ক রয়েছে যার বিস্তৃতি ২২ হাজার ৪৭৬.২৮ কিলোমিটার জুড়ে। এরমধ্যে জাতীয় মহাসড়ক ১১০টি (৩৯৯০.৭৫ কিলোমিটার), আঞ্চলিক সড়ক ১৪৭টি (৪৮৯৭.৭১ কিলোমিটার), জেলা সড়ক ৭৩৫টি (১৩৫৮৭.৮২ কিলোমিটার)।
আঞ্চলিক মহাসড়কগুলো মূলত জাতীয় মহাসড়ক থেকে জেলা শহর বা প্রধান নদীবন্দর ও স্থলবন্দরকে সংযুক্ত করে। এই ১৪৭টি আঞ্চলিক সড়ক ১০টি জোনের সড়ক নেটওয়ার্কের সাথে যুক্ত।
সাধারণত জাতীয় মহাসড়কের নামানুসারে, নাম ও সংখ্যা দিয়ে আঞ্চলিক মহাসড়কের নামকরণ করা হয়। যেমন কুমিল্লা-লালমাই, আর-১৪০। এখানে ‘আর’ অর্থ রিজিওনাল বা আঞ্চলিক।
সড়ক ও জনপথ বিভাগের দীর্ঘদিনের অভিযোগ- গত এক দশক ধরে সড়ক ও সেতুর রক্ষণাবেক্ষণ খরচ তথা ইজারা তিন গুণ বাড়লেও টোল না থাকায় এগুলোর রক্ষণাবেক্ষণের খরচ মেটানো যাচ্ছে না।
তাছাড়া নতুন সড়ক আগের চেয়ে প্রশস্ত ও বাড়ানো হয়েছে তাই টোল বসানোর এই পরিকল্পনাকে যৌক্তিক বলেই মনে করছেন পরিকল্পনামন্ত্রী এম এ মান্নান।
তিনি বলেন, ‘যারা এই সড়ক ব্যবহার করে লাভবান হবেন তারাই টোল দেবেন। সেতুর লেন প্রশস্ত হওয়ায় পরিবহনে সময় কম লাগছে, জ্বালানি সাশ্রয় হচ্ছে, আগের চেয়ে বেশি ট্রিপ দিতে পারছে। এই যে সময় বাঁচছে, পয়সা বাঁচছে সেটা বিবেচনায় রেখে তাদের তো টোল দিয়ে অংশগ্রহণ করা উচিত। গাড়ির জ্বালানি আর মানুষের সময়ের যে অপচয় হবে তার খরচ টোল দেয়া খরচের চেয়েও অনেক বেশি।’
এদিকে বিশ্বের বিভিন্ন দেশের মহাসড়কে টোল আদায়ের ব্যবস্থা থাকলেও সেগুলো আরোপ করা হয় অপেক্ষাকৃত দ্রুতগামী ও আধুনিক সুবিধা-সম্পন্ন বিকল্প সড়কগুলোর ক্ষেত্রে।
এ কারণে কেউ বাড়তি সুবিধা চাইলে তিনি টোল দিয়ে এক্সপ্রেসওয়ে ব্যবহার করতে পারবেন। আবার যার বাড়তি সুবিধার প্রয়োজন নেই তিনি টোল ছাড়া মূল সড়কে যাতায়াত করবেন। কিন্তু বাংলাদেশে মহাসড়কের পাশে বিকল্প সড়ক নেই। এমনকি বিকল্প সড়ক করার জায়গাও নেই। এক্ষেত্রে টোল আরোপ করা হলে সেটি একক সড়কের ক্ষেত্রেই প্রযোজ্য হবে।
কিন্তু বাংলাদেশে পরিবহন নেটওয়ার্ক সেই পরিকল্পনা মোতাবেক তৈরি হয়নি বলে জানিয়েছেন সড়ক ও পরিবহন বিশেষজ্ঞ সামসুল হক।
পরিবহন ব্যয় বাড়ার আশঙ্কা
নতুন করে আঞ্চলিক মহাসড়কগুলোকে টোলের আওতায় আনা হলে পরিবহন খরচ বাড়ার আশঙ্কা করছে খাত সংশ্লিষ্টরা। ফলে সাধারণ মানুষের খরচের বোঝা আরো ভারী হবে।
সড়ক ও পরিবহন বিশেষজ্ঞ সামসুল হক বলেন, ‘এটা ঠিক যে টোল বসালে পরিবহন খরচ বেড়ে যেতে পারে। আমরা সেটা বিবেচনায় রেখেই টোলের পরিমান নির্ধারণ করব। যেমন বাণিজ্যিক ট্রাকের জন্য যে অর্থ বরাদ্দ হবে সেটা সাধারণ মানের যাত্রীবাহী বাসের ক্ষেত্রে হবে না।’
সড়কে টোল আদায়ের ধারণা বাংলাদেশে নতুন নয়।
বর্তমানে দেশটির তিনটি মহাসড়কে ভিন্ন ভিন্ন হারে টোল আদায় হচ্ছে বলে সড়ক বিভাগ সূত্রে জানা গেছে। পরে দেশটির চার লেনের মহাসড়কে এবং ধাপে ধাপে ছয় লেন ও আট লেনের মহাসড়ককে টোলের আওতায় আনার কথা রয়েছে।
সড়ক বিভাগ বলছে, আঞ্চলিক মহাসড়কে টোল আরোপের ক্ষেত্রে ওই তিনটি সড়কের টোল হার বিবেচনায় রাখা হবে।
তবে মহাসড়কগুলোয় যে হারে টোল নেয়া হয়, আঞ্চলিক সড়ক ব্যবহারের ক্ষেত্রে তার চেয়ে কম হারে টোল আরোপের চিন্তাভাবনা হচ্ছে বলে জানান পরিকল্পনামন্ত্রী এম এ মান্নান।
তিনি জানান, সবার জন্য সহনীয় হয়, এমন হারেই টোল আরোপ করা হবে।
কোন কোন আঞ্চলিক সড়কের, কোন পয়েন্টে, কোন কোন বাহনের জন্য কী পরিমাণ টোল আদায় করা হবে সেসব বিষয়ে পরিকল্পনা এখনো প্রাথমিক পর্যায়ে আছে বলে তিনি জানান।
টোল আদায় অযৌক্তিক
একটি দেশের অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ডের মেরুদণ্ড হল সড়ক ও যোগাযোগ ব্যবস্থা। কোনো দেশের পরিবহন ব্যবস্থা যত গতিশীল তার আর্থিক প্রবৃদ্ধিও তত বেশি হয়।
কিন্তু অর্থনীতির চালিকাশক্তি এই সড়কগুলোয় টোলের মাধ্যমে প্রত্যক্ষ আয়ের চাইতে এর পরোক্ষ উপকারিতার দিকে বেশি গুরুত্ব দেয়ার পরামর্শ দিয়েছেন বিশেষজ্ঞরা।
এ বিষয়ে সড়ক ও পরিবহন বিশেষজ্ঞ সামসুল হক জানান, অবাধ যাতায়াতে অর্থনৈতিক কর্মচাঞ্চল্য হয়, কর্মসংস্থানের সুযোগ সৃষ্টি হয়, বৈদেশিক মুদ্রা অর্জনের সুযোগ হয়। অর্থাৎ এর পরোক্ষ অর্জন অনেক বেশি।
তাই যারা দূরদর্শী তারা কৌশলগত কারণেই বড় বড় সড়ক, মহাসড়ক, সেতু বানিয়ে সেগুলোয় অবাধে চলাচল করতে দেয়, কোনো টোল আরোপ করে না।
সামসুল হকের মতে, এর উপকারিতা তাৎক্ষণিক চোখে দেখা যাবে না। কিন্তু পরোক্ষ অর্জন হিসাব করলে দেখা যায় সেটি প্রত্যক্ষ আয়ের চাইতে অনেক বেশি।
তবে পরিকল্পনাটি প্রাথমিক অবস্থায় থাকায় এখনো এটি নিয়ে অনেক আলোচনার সুযোগ আছে বলে তিনি জানান।
এই টোল আদায়ের ক্ষেত্রে কী চ্যালেঞ্জ আছে এবং এই প্রত্যক্ষ অর্জনটি পরোক্ষ অর্জনের থেকে কতটা বেশি হবে- তা খতিয়ে দেখা উচিত বলে তিনি মনে করেন।
এছাড়া সরকার যদি টোল আদায়ের পরিকল্পনা করে, তাহলে নিয়ম হল সেটি সড়কের নির্মাণ ও নকশা প্রণয়নের আগেই করা।
সেক্ষেত্রে সড়কের নকশা টোল আদায়ের উপযোগী করে তৈরি করতে হয়। না হলে ঘন ঘন টোল প্লাজার কারণে মহাসড়কের গতিশীলতা রক্ষা করা যায় না।
এ বিষয়ে সামসুল হক বলেন, ’টোল প্লাজা এক্সপ্রেসওয়েতে হতে পারে। কিন্তু জাতীয়, আঞ্চলিক বা জেলা মহাসড়কে টোল আদায়ের কোনো যৌক্তিকতা নেই। কারণ এসব সড়কের সাথে ছোট বড় আরো নানা সড়কের যত্রতত্র সংযোগ রয়েছে। তখন টোলের মতো কন্ট্রোল মেকানিজম আরোপ করাটা কঠিন।’
এক্ষেত্রে টোল তুলতে গেলে একাধিক টোল প্লাজা বাসানোর প্রয়োজন হয়। টোল প্লাজা বেড়ে গেলে রাস্তা সঙ্কীর্ণ হয়ে যাত্রা বাধাগ্রস্ত হয়। এতে মহাসড়কে যানজটেরও আশঙ্কা দেখা দেয়।
সড়ক রক্ষণাবেক্ষণে মান্ধাতার আমলের পদ্ধতি
সরকার সাধারণত সড়ক, মহাসড়ক ও সেতুর রক্ষণাবেক্ষণের জন্য টোল আদায় করে থাকে। কিন্তু ওই অবকাঠামো একবার ক্ষতিগ্রস্ত হলে সেটি এক দীর্ঘসূত্রিতার ফাঁদে পড়ে যায়।
সরকার টাকার অভাবে সঠিক সময়ে মেরামত করতে পারছে না এমনটা মানতে নারাজ বিশেষজ্ঞরা। বরং সুষ্ঠু ব্যবস্থাপনার অভাবেই এমন পরিস্থিতির সৃষ্টি হয়েছে বলে তারা মনে করেন।
সড়ক ও পরিবহন বিশেষজ্ঞ সামসুল হকের মতে, বাংলাদেশের সরকার এত বছরেও সড়ক রক্ষণাবেক্ষণের বাজেট আলাদা করতে পারেনি।
অথচ সড়ক মেরামতের লক্ষ্যে প্রায় দুই দশক আগে একটি ‘রোড ফান্ড’ গঠন করা হয়েছিল। কথা ছিল, বাংলাদেশ সড়ক ও যোগাযোগ কর্তৃপক্ষ (বিআরটিএ) নিবন্ধন বাবদ যে কোটি কোটি টাকা আয় হয় সেটি রোড ফান্ডে চলে যাবে।
সেই সাথে উন্নয়ন বাজেটের এক ভাগ যুক্ত হবে। এরপর আরো প্রয়োজন হলে সেটি দাতারা সরবরাহ করবেন।
কিন্তু তৎকালীন রাজনৈতিক মারপ্যাঁচে এবং দুই মন্ত্রণালয়ের কর্তৃত্বের বিতর্কে এই রোড ফান্ড আলোর মুখ দেখেনি।
বাংলাদেশে এখনো সড়কের রক্ষণাবেক্ষণের কাজ হয় মান্ধাতার আমলের প্রতিক্রিয়ামূলক পদ্ধতিতে।
যেখানে আগে রাস্তা ক্ষতিগ্রস্ত হবে, মানুষের ভোগান্তি হবে, সেটি টেন্ডারে যাবে, বাজেট পাস হবে, ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠান নিযুক্ত হবে, এরপর মেরামতের কাজ হবে।
যেখানে কি না উন্নত দেশে চলে প্রতিরোধমূলক রক্ষণাবেক্ষণ ব্যবস্থা। অর্থাৎ ঠিকাদারকে আগেই বলা থাকবে এই রাস্তায় কোনো ভাঙ্গাচোরা থাকতে পারবে না।
এজন্য কিলোমিটার প্রতি তাদের জন্য অর্থ বরাদ্দ থাকে। ঠিকাদার সারাবছর স্ক্যানিং করে প্রতিনিয়ত রক্ষণাবেক্ষণ চালিয়ে যায়। রাস্তা নষ্ট হতে দেয় না।
বাংলাদেশের সড়ক কর্তৃপক্ষ জানে তাদের প্রতি কিলোমিটার রক্ষণাবেক্ষণ বাবদ কত খরচ হতে পারে। এটি তাদের জানা থাকলে ঠিকাদারদের তারা নির্দিষ্ট এলাকাজুড়ে মেরামতের জন্য অর্থ বরাদ্দ দেবে। শর্ত থাকবে রাস্তায় কোনো ভাঙন থাকা যাবে না।
এই খরচ তোলার জন্য রাস্তায় টোল আরোপের পরিবর্তে ‘রোড ফান্ড’ কার্যকরের পরামর্শ দিয়েছেন সামসুল হক।
তার মতে, বাংলাদেশের বিদ্যমান সড়কগুলোর রক্ষণাবেক্ষণ ব্যবস্থাকে আধুনিকায়ন করলে সেগুলো টেকসই হবে এবং দীর্ঘ সময় ব্যবহারের সুযোগ থাকবে।
সামসুল হক বলেন, ‘যদি টেকসই উন্নয়ন করতে হয় তাহলে যেসব সড়ক আছে সেটার সর্বোচ্চ ব্যবহার নিশ্চিত করতে নিয়মিত মেরামত করতে হবে। এই মেরামতের টাকা যদি বার বার চাইতে হয় তাহলে বরাদ্দ দেরিতে হবে। ততদিনে আরো ক্ষতি হবে। ফলে সড়কের উপকারিতা আর মানুষ পাবে না।’
এক্ষেত্রে টোল আইন-১৯৮৫ এবং টোল নীতিমালা-২০১৪ হালনাগাদের পাশাপাশি সড়ক নীতিমালায় পরিবর্তন আনা প্রয়োজন বলে বিশেষজ্ঞরা মনে করছেন।
সূত্র : বিবিসি