জ্বালানি তেলের দাম বৃদ্ধি
অনলাইন ডেস্ক ০৮ আগস্ট ২০২২, ২০:২৫
জ্বালানি তেলের দাম বৃদ্ধিতে সবচেয়ে বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হওয়ার ঝুঁকিতে রয়েছে দেশের কৃষি ক্ষেত্র। কৃষিতে সেচযন্ত্র, যান্ত্রিক কৃষির সুবাদে ধান কাটা, মাড়াই ও পরিবহন থেকে শুরু করে অন্যান্য কাজে ডিজেল ব্যবহৃত হয়। এ ছাড়া গৃহস্থালিসহ অন্যান্য কাজে ব্যবহৃত হয় কেরোসিন তেল। এ অবস্থায় ডিজেল ও কেরোসিনের দাম বাড়ানোতে কৃষকের অতিরিক্ত খরচ হবে প্রায় পাঁচ হাজার কোটি টাকা।
ইউরিয়া সারের মূল্য কেজিতে ছয় টাকা বৃদ্ধির কয়েক দিনের মাথায় সরকার জ্বালানি তেলের দাম বৃদ্ধিতে কৃষি উৎপাদনে মারাত্মক নেতিবাচক প্রভাব পড়বে বলে মনে করছেন কৃষি অর্থনীতিবিদরা। প্রথমেই প্রভাব আসব চলমান রোপা আমন চাষে। এরপর সবচেয়ে প্রভাব পড়বে আগামী বোরো আবাদে। খাদ্য উৎপাদন ব্যাহত হওয়ার পাশাপাশি কৃষিপণ্যের দামও ক্রেতাদের নাগালের বাইরে চলে যাওয়ার শঙ্কা করছেন সংশ্লিষ্টরা। এতে শুধু যে, কৃষি ও কৃষকই ক্ষতিগ্রস্ত হবে তা নয়, সামগ্রিক অর্থনীতিতেই বড় ধরনের নেতিবাচক প্রভাব পড়বে। ভোগান্তি বাড়বে নিম্ন ও মধ্যবিত্তের মানুষের মধ্যে।
গত ২ আগস্ট ইউরিয়া সারের দাম কেজিতে ছয় টাকা বাড়ানোর ঘোষণা দেয় সরকার। এতে কৃষকদের মধ্যে অতিরিক্ত খরচ নিয়ে দুশ্চিন্তার রেশ উদ্যোগ হয়। এই রেশ কাটার আগেই গত শুক্রবার ছুটির দিন রাতে হঠাৎই জ্বালানি তেলের দাম বাড়ানোর ঘোষণা দেয় সরকার। এ দিন ৮০ টাকার ডিজেল ও কেরোসিন ১১৪ টাকা লিটার (৩৪ টাকা বৃদ্ধি), ৮৯ টাকার অকটেন লিটারে ১৩৫ টাকা (৪৬ টাকা বৃদ্ধি) এবং ৮৬ টাকার পেট্রল ১৩০ টাকা (৪৪ টাকা বৃদ্ধি) বাড়িয়ে বিজ্ঞপ্তি জারি করে বিদ্যুৎ, জ্বালানি ও খনিজসম্পদ মন্ত্রণালয়। এতে কৃষি, শিল্পসহ সামগ্রিক উৎপাদনে নেতিবাচক প্রভাব পড়েছে। বিশেষ করে ডিজেল ও কেরোসিনের দাম কেজিতে ৩৪ টাকা বাড়ানোর ফলে কৃষি উৎপাদন চরমভাবে ব্যাহত হওয়ার আশঙ্কা করছেন সংশ্লিষ্টরা। প্রায় ৯ মাস আগে গত ৩ নভেম্বর ডিজেল ও কেরোসিনের দাম লিটারে ১৫ টাকা বাড়িয়ে ৬৫ টাকা থেকে ৮০ টাকায় নিয়ে যায় সরকার। এতে কৃষিতে বড় ধরনের ধাক্কা লাগে। এই ধাক্কা কাটতে না কাটতেই গত শুক্রবার রাতে হঠাৎই ডিজেল ও কেরোসিনের দাম লিটারে ৩৪ টাকা বাড়িয়ে দিয়েছে সরকার। এতে কৃষকদের মধ্যে আতঙ্ক সৃষ্টি করেছে।
বিপিসির পরিসংখ্যান অনুযায়ী, ২০২০-২১ অর্থবছরে চাহিদা ছিল প্রায় ৬৬ লাখ মেট্রিক টন। দেশে ক্রমেই জ্বালানি তেলের চাহিদা বৃদ্ধি পাচ্ছে। ব্যবহৃত জ্বালানির ৭৩.১১ শতাংশ ডিজেল, ৬.৬২ শতাংশ ফার্নেস অয়েল, ৫.৮৬ শতাংশ পেট্রল, ৪.৭৮ শতাংশ অকটেন, ১.৯২ শতাংশ কেরোসিন, ৬.২৭ শতাংশ জেট এ-১ এবং ১.৪৪ শতাংশ অন্যান্য তেল। এ ছাড়া আর জ্বালানি তেলের ৬৪.২৭ শতাংশ পরিবহন, ১৮ শতাংশ কৃষি, ৭.৬৫ শতাংশ শিল্প, ৬.৭৪ শতাংশ বিদ্যুৎ, ১.৯৭ শতাংশ গৃহস্থালি এবং ১.৩৭ শতাংশ অন্যান্য খাতে ব্যবহার হয়েছে। আর ব্যবহৃত জ্বালানি তেলের প্রায় ৮৪ শতাংশ নৌপথে, ৯ শতাংশ রেলপথে এবং ৭ শতাংশ সড়কপথে পরিবহন হয়ে থাকে।
দেশে প্রায় ১৬ লাখ সেচযন্ত্র আছে। এর মধ্যে প্রায় ৭০ ভাগ ডিজেলচালিত, বাকি বিদ্যুৎচালিত। সেচ ছাড়াও ডিজেল তেল অন্যান্য কাজেও লাগে। পুরো এগ্রিকালচার সেক্টরই এখন প্রায় যান্ত্রিকীকরণ হয়ে গেছে। ইরিগেশনে ডিজেল লাগে, পাশাপাশি বিদ্যুৎও লাগে। এর বাইরে ধান কাটাসহ পুরো কৃষি প্রায় যান্ত্রিক নির্ভর। সব মিলিয়ে সারা বছর প্রায় ১১ লাখ টন ডিজেল লাগে। ইরিগেশনেই ৬-৭ লাখ টন ডিজেল লাগে।
বিপিসির তথ্য পর্যালোচনাসহ সংশ্লিষ্টদের সাথে কথা বলে জানা যায়, দেশে মোট প্রায় ৪৮ লাখ মেট্রিক টন ডিজেল ব্যবহৃত হয়। এর মধ্যে প্রায় ১২ লাখ টন ব্যবহৃত হয়ে আসছে সেচসহ কৃষিকাজে। বোরো আবাদ পুরোপুরি সেচনির্ভর হলেও আমন আবাদে কমই সেচ দিতে হতো। কিন্তু এবার অনাবৃষ্টির ফলে এমনিতেই আমন চাষ দেরি হয়েছে। এবার বেশির ভাগই সেচযন্ত্র চালু করতে হয়েছে কৃষককে। ফলে ডিজেলের চাহিদা আরো বেড়েছে বা বাড়বে। এ অবস্থায় প্রতিলিটার ডিজেলে ৩৪ টাকা বাড়ানোর ফলে কৃষককে এবার প্রায় চার হাজার ২০০ কোটি টাকা অতিরিক্ত খরচ করতে হবে। অন্য দিকে দেশে গৃহস্থালিসহ অন্যান্য কাজে ব্যবহৃত কেরোসিনের পেছনেও অতিরিক্ত খরচ গুনতে হবে প্রায় ৮০০ কোটি টাকা। সব মিলিয়ে ডিজেল ও কেরোসিনের পেছনেই মানুষের প্রায় পাঁচ হাজার কোটি টাকা অতিরিক্ত খরচ গুনতে হবে।
এ বিষয়ে শেরে বাংলা কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়ের কৃষি তথ্য বিভাগের অধ্যাপক ড. পরিমল কান্তি বিশ্বাস বলেন, ডিজেলসহ অন্যান্য জ্বালানির সাথে ইরিগেশনের সরাসরি সম্পর্ক। দাম বৃদ্ধিতে উৎপাদন খরচ ও পরিবহন খরচ বাড়বে।
বাংলাদেশ কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়ের (ময়মনসিংহ) কৃষি অর্থনীতি বিভাগের প্রধান অধ্যাপক ড. হাসনীন জাহান বলেন, ইউরিয়া সারের দাম বাড়ানো হয়েছে কয়েক দিন আগে। এতে খুব বেশি প্রভাব না পড়লেও ডিজেলের দাম বৃদ্ধিতে কৃষি উৎপাদনে নেতিবাচক প্রভাব পড়বে। যেহেতু ইরিগেশনের বড় অংশ ডিজেলের ওপর নির্ভর করে। বিশেষ করে যেসব এলাকায় গ্রাউন্ড ওয়াটারের ওপর নির্ভরশীল, ডিজেলে সেচের ওপরই নির্ভর করতে হয়। কৃষির জন্য ব্যবহৃত ডিজেলের ক্ষেত্রে সরকারকে আরো চিন্তা করা উচিত উল্লেখ করে তিনি বলেন, আমাদের খাদ্য উৎপাদনের লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ করা থাকে। কোনো কারণে যদি এই লক্ষ্যমাত্রা অর্জন না হয় তা হলে আমদানির ওপর নির্ভর করতে হবে। আমরা যেন অভ্যন্তরীণ উৎপাদন দিয়েই চাহিদাটা পূরণ করতে পারি সেটি অর্জনে যা যা করণীয় সে পদক্ষেপ নেয়া উচিত। যেহেতু এখন গ্লোবাল ক্রাইসিও চলছে। বাইরের আমদানির ওপর নির্ভরশীলতা কমিয়ে আনতে হবে। খাদ্য অপচয় যাতে না হয়, পণ্য পরিবহনও যাতে স্বাভাবিক থাকে। ডিস্ট্রিবিউশন, মার্কেটিংয়েও গুরুত্ব দিতে হবে।
এ বিষয়ে কৃষি অর্থনীতিবিদ ড. জাহাঙ্গীর আলম খান বলেন, আগেরবার এবং এবার মিলে ডিজেল ও কেরোসিনের দাম প্রায় ডাবল বেড়েছে। দুটোই ব্যবহার করেন আমাদের কৃষক, গ্রামের মানুষ। গ্রামীণ জীবনে এর ফলে অসচ্ছলতা বেড়ে যাবে। দ্বিতীয়ত, কৃষি উৎপাদন দারুণভাবে বিঘ্নিত হবে। তৃতীয়ত, সাধারণ মূল্যস্ফীতিকে উস্কে দেবে। যার ফলে মানুষ যা কিছুই কিনুক বেশি দিতে হবে। চতুর্থত, আমরা যান্ত্রিক চাষাবাদের কথা বলছি, যান্ত্রিক চাষাবাদকে আমরা উৎসাহিত করতে চাই। যান্ত্রিক চাষাবাদও নিরুৎসাহিত হবে। কারণ ট্রাক্টর, পাওয়ার টিলার, কম্বাইন হারভেস্টার, রিপার- সব কিছুই তো তেলে বা ডিজেলে চলে। এতে কৃষকের সব কিছুতেই যখন দাম বেড়ে যাবে, উৎপাদন দারুণভাবে ক্ষতির সম্মুখীন হবে।
বাংলাদেশ কৃষি অর্থনীতিবিদ সমিতির সাবেক এই সভাপতি বলেন, এমন সময় দামটি বাড়ল যখন রোপা আমন চাষ হচ্ছে। বন্যা হয়েছিল, এরপর দীর্ঘ খরা। এ কারণে এমনিতেই আমন ধান চাষ এবার বিলম্বিত হচ্ছে। এখন সাপ্লিমেন্টারি ইরিগেশন অবধারিত হয়ে গেছে।
তবে, কৃষি মন্ত্রণালয়ের সাবেক সচিব ড. আনোয়ার ফারুক বলেন, ইউরিয়া সারে হয়তো খুব বেশি প্রভাব পড়বে না, ২০০-২৫০ টাকা বিঘাপ্রতি খরচ বাড়বে। কিন্তু বড় প্রভাব পড়বে ডিজেলের দাম বাড়ানোতে। ইরিগেশনসহ কৃষি উৎপাদন খরচ বেড়ে যাবে।
পরিবহনসহ সব ধরনের ভাড়া বাড়বে। যার ফলে প্রতিটি জিনিসের দাম বৃদ্ধি পাবে। তেলের দাম তো অনেক বেড়েছে, ৩৪ টাকা লিটারে। ভর্তুকি সামাল দিয়ে ডিজেলের দাম কমিয়ে রাখা গেলে ভালো হতো।