অনলাইন ডেস্ক ৩১ জুলাই ২০২২,৬:৩৩ পিএম
বিদেশ থেকে বিলাসী পণ্য আমদানিতে ৮৫০ কোটি ডলারের ঋণ নেওয়া হয়েছে, যা বাংলাদেশি মুদ্রায় প্রায় ৮১ হাজার কোটি টাকা। আমদানিকারক বা ক্রেতার সুবিধা মতো বিভিন্ন দেশ থেকে পণ্য আমদানির বিপরীতে ব্যাংক বা রপ্তানিকারক প্রতিষ্ঠানের কাছ থেকে নেওয়া হয়েছে এসব ঋণ। চড়া সুদ ও কঠিন শর্তে বেসরকারি খাতে নেওয়া এ ঋণের সবই স্বল্পমেয়াদি।এদিকে ডলারের বিপরীতে টাকার অবমূল্যায়নের কারণে ঋণের অঙ্ক বেড়েই যাচ্ছে। এগুলো স্বল্পমেয়াদি ঋণ হওয়ায় বৈদেশিক মুদ্রার সংকটে অনেক ঋণ পরিশোধ করা সম্ভব হচ্ছে না। এতে ঋণের মেয়াদ বাড়াতে হচ্ছে, যা এখন গলার কাঁটা হয়ে দাঁড়িয়েছে। একই সঙ্গে দেশের বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভের ওপর চাপ সৃষ্টি করেছে।
প্রতিবেদন থেকে দেখা যায়, ২০২০ সালে বায়ার্স ক্রেডিট ছিল ৪৩৫ কোটি ডলার। ২০২২ সালের জুন পর্যন্ত তা প্রায় দ্বিগুণ বেড়ে ৮৫০ কোটি ডলারে দাঁড়িয়েছে। আলোচ্য দেড় বছরে ঋণ বেড়েছে ৪১৫ কোটি ডলার বা ৯৫ দশমিক ৪ শতাংশ।
এই ধরনের ঋণের মেয়াদ থাকে সাধারণত মাত্র ছয় মাস। এ সময়ের জন্য কমপক্ষে ৬ শতাংশ হারে সুদ দিতে হয়। এর সঙ্গে রয়েছে বিভিন্ন ধরনের সার্ভিস চার্জ। সব মিলে সুদের হার দাঁড়ায় ৮ শতাংশের বেশি। চীন, যুক্তরাষ্ট্র, যুক্তরাজ্য, ভরত, সংযুক্ত আর আমিরাত, কানাডা-এসব দেশ থেকে ওই ঋণ দেওয়া হয়। এসব দেশে মূল্যস্ফীতির হার কম। এছাড়া বৈদেশিক মুদ্রায় এ সুদ দিতে হয় বলে কার্যকর সুদ অনেক বেশি পড়ে, যা বাংলাদেশের ১৪/১৬ শতাংশ সুদের চেয়ে বেশি। এছাড়া নিয়মিত ঋণ পরিশোধ করতে ব্যর্থ হলে বিভিন্ন ধরনের চার্জ আরোপ করা হয়। এগুলো হচ্ছে-আমদানিকারকের ব্যাংক, রপ্তানিকারকের ব্যাংক ও রপ্তানিকারকের সঙ্গে আমদানিকারকের চুক্তির শর্ত। এতে ঋণের খরচ আরও বেড়ে যায়। মুদ্রার বিনিময় হার অস্থিতিশীল হলে ঋণের দায় বৃদ্ধি পায়। যেমনটি হয়েছে বর্তমানে। গত জানুয়ারি থেকে জুলাই পর্যন্ত সাত মাসে ডলারের বিপরীতে টাকার অবমূল্যায়ন হয়েছে ৮ টাকা ৯৫ পয়সা। গত ডিসেম্বরে প্রতি ডলারের দাম ছিল ৮৫ টাকা ৮০ পয়সা। এ হিসাবে ৮৫০ কোটি ডলারের বায়ার্স ক্রেডিট স্থানীয় মুদ্রায় ছিল ৭৩ হাজার কোটি টাকা। এখন ঋণ পরিশোধের জন্য ডলার কিনতে হবে ৯৪ টাকা ৯৫ পয়সায়। এ হিসাবে ঋণ বেড়ে দাঁড়িয়েছে ৮১ হাজার কোটি টাকায়। শুধু টাকার অবমূল্যায়নের কারণে ঋণ বেড়েছে ৮ হাজার কোটি টাকা।
এ প্রসঙ্গে কেন্দ্রীয় ব্যাংকের সাবেক গভর্নর ড. সালেহউদ্দিন আহমেদ বলেন, বায়ার্স ক্রেডিটের প্রায় সবই বিলাসী পণ্য ঋণ। বিদেশি কোম্পানিগুলো তাদের পণ্য বিক্রি করতে বিশেষ সুবিধায় আমদানিকারকদের তা দিয়ে থাকে। এ ধরনের ঋণ অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ড বাড়াতে সহায়ক। কিন্তু তা বড় ঝুঁকি সৃষ্টি করে। যেমন এখন হয়েছে। বায়ার্স ক্রেডিট স্বল্পমেয়াদি ঋণ হওয়ায় এগুলো পরিশোধে রিজার্ভের ওপর চাপ তৈরি হয়। এসব ঋণের কিস্তি এক বা দুইবার পরিশোধে ব্যর্থ হলে দুর্নাম হয়ে যায়। ফলে ঋণ নেওয়ার ক্ষেত্রে সতর্ক হওয়ার প্রয়োজন ছিল। প্রতিবেদনে দেখা যায়, বায়ার্স ক্রেডিটের ৫৩ শতাংশই বিলাসী পণ্য আমদানিতে ব্যয় হয়েছে। বাকি ৪৭ শতাংশের মধ্যেও পরোক্ষভাবে বিলাসী পণ্য রয়েছে। তবে এর মাধ্যমে আমদানি করা কিছু পণ্য শিল্প খাতে ব্যবহৃত হয়েছে, যা খুবই নগণ্য। এর মাধ্যমে উৎপাদিত পণ্যও বিলাসী হিসাবেই বিবেচিত।
বায়ার্স ক্রেডিটের মধ্যে উদ্ভিদজাতীয় পণ্য আমদানিতে ১২৪ কোটি ডলার, পশু বা উদ্ভিদজ চর্বি, মোম, অটো মোবাইলজাতীয় পণ্য, ভোজ্য চর্বি আমদানিতে ৯৯ কোটি ডলার, যান্ত্রিক যন্ত্রপাতি, বৈদ্যুতিক সরঞ্জাম, তার, সাউন্ড রেকর্ডার এবং রিপ্রডিউসার, টেলিভিশন ইমেজ-এই ধরনের যন্ত্রপাতি ও এর অংশবিশেষ আমদানিতে ৬৬ কোটি ডলার খরচ হয়েছে। এর মধ্যে বেশির ভাগ পণ্যই দেশে উৎপাদিত হয়। কিছু পণ্য আমদানি করতে হয়। কিন্তু উদ্যোক্তা দেশে উৎপাদিত হয় এমন পণ্যও আমদানি করছেন।
এছাড়াও তৈরি খাদ্যসামগ্রী যেমন : পরটা, মিষ্টি, কোমল পানীয়, স্পিরিট, ভিনেগার, তামাক আমদানিতে ৩৯ কোটি ডলার ব্যয় হয়েছে। প্লাস্টিক এবং রাবার আমদানিতে ২৩ কোটি ডলার। কাঠ বা অন্যান্য তন্তুযুক্ত সেলুলোসিক উপাদান, কাগজ বা পেপার বোর্ড আমদানিতে ব্যয় হয়েছে ৮ কোটি ডলার। জীবন্ত প্রাণী এবং পশুপণ্যে ৭ কোটি ১২ লাখ ডলার, অপটিক্যাল, ফটোগ্রাফিক, সিনেমাটোগ্রাফিক, ঘড়ি, বাদ্যযন্ত্র আমদানিতে ৯৮ লাখ ডলার ব্যয় হয়েছে। কাঠ এবং কাঠের উপকরণ, কাঠের কয়লা, কর্ক খড়, ঝুড়ি, বেতের সামগ্রী আমদানিতে ৯২ লাখ ডলার; পাথর, প্লাস্টার, সিমেন্ট, মাইকা, সিরামিক, কাচ, কাচের পাত্র আমদানিতে ৮১ লাখ ডলার এবং জুতা, ছাতা, সূর্যের আলোর ক্ষতিকর রশ্মি রোধকারী ছাতা, হাঁটার লাঠি, আসন লাঠি, চাবুক, রাইডিং ক্রপস আমদানিতে ৩৯ লাখ ডলার ব্যয় হয়েছে।
এর বাইরে কাঁচা চামড়া এবং পাকা চামড়া, ভ্রমণসামগ্রী, হ্যান্ডব্যাগ প্রাণীর অন্ত্রের উপকরণ আমদানিতে ৪ লাখ ডলার এবং অপটিক্যাল, ফটোগ্রাফিক আমদানিতে দেড় লাখ ডলার ব্যয় হয়েছে।
এসব পণ্যের বেশির ভাগই দেশে উৎপাদিত হয়। দেশি পণ্য ব্যবহার না করে বিদেশ থেকে খ্যাতিমান ব্র্যান্ডের ওইসব পণ্য আমদানি করা হচ্ছে। পণ্যগুলো আমদানিতে রপ্তানিকারকরা দেশীয় উদ্যোক্তাদের নানাভাবে অনুপ্রাণিত করে। একই সঙ্গে বিদেশি ঋণসহ অন্যান্য সুবিধাও দিয়ে থাকে। দেশে উৎপাদিত হয় না এমন পণ্যের মধ্যে বিভিন্ন যানবাহন, বিমান, জাহাজ এবং সংশ্লিষ্ট পরিবহণ সরঞ্জাম আমদানিতে ব্যয় হয়েছে ৪১ কোটি ডলার। তবে যানবাহন, জাহাজ এখন দেশে তৈরি হচ্ছে। এগুলো বিদেশে রপ্তানিও হচ্ছে। শিল্প খাতে ব্যবহৃত পণ্যের মধ্যে খনিজ উপকরণ আমদানিতে ১৪৩ কোটি ডলার, বেস মেটাল ও মৌলিক বেস মেটালে ১৬৪ কোটি ডলার, রাসায়নিক বা সহযোগী শিল্পের পণ্যে ৬৫ কোটি ডলার, টেক্সটাইল এবং টেক্সটাইল উপকরণ আমদানিতে ব্যয় হয়েছে ২৫ কোটি ডলার। বিবিধ পণ্য আমদানিতে ব্যয় হয়েছে ৮১ লাখ ডলার।
২০০১ সালের সবচেয়ে বেশি ঋণ বেড়েছে অক্টোবর থেকে ডিসেম্বর সময়ে। ওই বছরের ৩০ সেপ্টেম্বর পর্যন্ত ঋণ ছিল ৫৮৮ কোটি ডলার। ডিসেম্বরে তা বেড়ে দাঁড়িয়েছে ৮২১ কোটি ডলার। ওই তিন মাসে ঋণ বেড়েছে ২৬২ কোটি ডলার বা ৪৫ শতাংশ। বাকি ৪০ শতাংশ বেড়েছে জানুয়ারি থেকে সেপ্টেম্বর-এই নয় মাসে।
প্রতিবেদন থেকে দেখা যায়, গত ৮ বছরে বায়ার্স ক্রেডিট বেড়েছে ৮ গুণের বেশি। ২০১৪ সালে এ ঋণ ছিল ১০২ কোটি ডলার, ২০১৫ সালে তা দ্বিগুণ বেড়ে দাঁড়ায় ২০২ কোটি ডলারে। ২০১৬ সালে সামন্য কমে দাঁড়ায় ১৮৯ কোটি ডলারে। ২০১৭ সালে তা আবার বেড়ে হয় ২৬৫ কোটি ডলার। ২০১৮ সালে প্রায় দ্বিগুণ বেড়ে বায়ার্স ক্রেডিট দাঁড়ায় ৫০০ কোটি ডলারে। ২০১৯ সালে সামান্য কমে আবার ৪৩১ কোটি ডলার হয়। ২০২০ সালে তা আবার বেড়ে ৪৩৫ কোটি ডলার হয়। ২০২২ সালের জুন পর্যন্ত প্রায় দ্বিগুণ বেড়ে দাঁড়ায় ৮৫০ কোটি ডলার।
সূত্র জানায়, আমদানিকারক বা ক্রেতা নিজে দরকষাকষি করে বিদেশি ব্যাংক বা রপ্তানিকারক প্রতিষ্ঠান থেকে এসব ঋণ গ্রহণ করেন। এ কারণে একে ‘বায়ার্স ক্রেডিট’ বা ‘ক্রেতা ঋণ’ বলা হয়। বেসরকারি খাতের উদ্যোক্তারা এসব ঋণ নিয়ে থাকেন। দুইভাবে বায়ার্স ক্রেডিট নেওয়া হয়। বিদেশি প্রতিষ্ঠানগুলোর উৎপাদিত পণ্য বাজারজাত করার অংশ হিসাবে তারা আমদানিকারককে বাকিতে পণ্য সরবরাহ করে। যা ঋণ হিসাবে বিবেচিত হয়। আমদানিকারক ছয় মাস পর ঋণ পরিশোধ করেন। রপ্তানিকারক প্রতিষ্ঠান কোনো ব্যাংকের মাধ্যমে আমদানিকারককে ঋণের ব্যবস্থা করে পণ্যটি সরবরাহ করেন। এতে রপ্তানিকারক অর্থ পেয়ে যান। কিন্তু আমদানিকারক পরে ব্যাংককে ঋণ শোধ করেন। বিদেশি প্রতিষ্ঠানগুলো তাদের উৎপাদিত পণ্য বাজারজাত করার জন্য এসব ঋণের জোগান দিয়ে থাকে। এক্ষেত্রে বেশির ভাগ পণ্যই ভোগ বিলাসে ব্যবহৃত হয়। তবে খুব কম পণ্যই আসে শিল্পের কাঁচামাল বা সহযোগী যন্ত্রপাতি হিসাবে। সেবা খাতের জন্য কিছু পণ্য এ প্রক্রিয়ায় আমদানি হয়।