অনলাইন ডেস্ক বৃহস্পতিবার,২৫ আগস্ট ২০২২ ২১ঃ২৪
রোহিঙ্গা শরণার্থীরা বলছেন, বাংলাদেশে ক্যাম্পে তাদের কোনো ভবিষ্যৎ নেই, কিন্তু মিয়ানমারের পরিস্থিতি তাদের দেশে ফেরত যেতে বাধা দিচ্ছে।বেসামরিক লোকদের হত্যা করা হয়েছিল,মেয়েদের এবং মহিলাদের ধর্ষণ করা হয়েছিল এবং পুরো গ্রামগুলিকে ভেঙ্গে ফেলা হয়েছিল। প্রায় ৭০০,০০০ রোহিঙ্গা প্রতিবেশী বাংলাদেশে পালিয়ে এসেছে,যেখানে বেশিরভাগই আজও শরণার্থী শিবিরে রয়ে গেছে।
মিয়ানমারে রোহিঙ্গাদের প্রতি দৃষ্টিভঙ্গি বদলে যাচ্ছে বলে মনে হচ্ছে। যাইহোক,প্রতিবেশী বাংলাদেশ থেকে শরণার্থীদের সেনাবাহিনী তাড়িয়ে দেওয়ার পাঁচ বছর পর তাদের প্রত্যাবর্তন খুব শীঘ্রই প্রত্যাশিত নয়। পাঁচ বছর আগে সেনা নির্যাতনের মুখে নিজ দেশ ছেড়ে বাংলাদেশে আশ্রয় নিয়েছিলেন কয়েক লাখ রোহিঙ্গা৷ নিরাপদে দেশে ফেরার প্রত্যাশা নিয়ে দিন গোনা রোহিঙ্গাদের অবশ্য এখনও দিন কাটে অনিশ্চয়তায়৷রোহিঙ্গা নারী হাসিনা বেগম তার বাবাকে ঘরের জন্য কূপ থেকে পানি আনতে বললেন৷ হাসিনার স্বামী শরণার্থী ক্যাম্পের ভেতরেই একটু দূরে যাবেন৷ আর তাই পানি আনার দায়িত্ব তারা বাবার ওপর৷ ২৩ বছরের হাসিনা নিজে পানি আনতে পারেন না৷ কারণ,তার শারীরিক সমস্যা আছে৷ হলুদ রঙের দোপাট্টা জড়িয়ে শারীরিক অক্ষমতা লুকিয়ে রাখার চেষ্টা হাসিনার৷ কীভাবে এমন সমস্যা হলো জানতে চাইলে হাসিনা পাঁচ বছর আগের কথা মনে করলেন৷হাসিনা জানান, তারা (মিয়ানমারের সেনাসদস্যরা) আমাকে রড দিয়ে আঘাত করল, শরীর দিয়ে রক্ত পড়ছিল,তারা আমাকে টেনে-হিঁচড়ে নিয়ে আসলো৷ তারা ভাবল, আমি মারা গেছি৷ তখন আমাকে ফেলে চলে গেল৷ রডের তীব্র আঘাতের ব্যথা পা ও মাথায় পাঁচ বছর পর অর্থাৎ এখনও টের পান হাসিনা৷ মিয়ানমারের সেনা নির্যাতনের মুখে দেশ ছেড়ে বাংলাদেশের কক্সবাজারের শরণার্থী ক্যাম্পে আশ্রয় নেওয়া লাখ লাখ রোহিঙ্গার একজন হাসিনা বেগম৷ ২০১৭ সালের ২৫ আগস্ট রাখাইনে রোহিঙ্গাদের ওপর হত্যা, ধর্ষণসহ নারকীয় নির্যাতন চালায় মিয়ানমারের সেনারা৷ আন্তর্জাতিক সংস্থাগুলোর দাবি,সেনাবাহিনীর এই অভিযানে হাজার হাজার রোহিঙ্গা নিহত হয়েছেন৷ সে সময় নির্যাতন এড়াতে প্রায় আট লাখ রোহিঙ্গা প্রতিবেশী বাংলাদেশে আশ্রয় নেন।কক্সবাজারের বালুখালি ক্যাম্পের একটি ছোট ঘরে স্বামী ও এক সন্তান নিয়ে থাকেন হাসিনা বেগম৷ এ ক্যাম্পটি বিশ্বের সবচেয়ে বড় শরণার্থী ক্যাম্প৷ মিয়ানমার থেকে পালিয়ে আসা প্রায় ছয় লাখ রোহিঙ্গা বাস করেন এখানে৷এমন ৩৫টি ক্যাম্পে বর্তমানে প্রায় ১০ লাখ রোহিঙ্গা রয়েছে৷ এর প্রায় ৭০ ভাগই ২০১৭ সালে ২৫ আগস্টের পর মিয়ানমার থেকে পালিয়ে এসেছেন৷হাসিনা বেগম বলেন, আমার স্বামীর কোনো কাজ নেই৷ তিনি তাবলিগ করেই সময় কাটান৷ আমরা খাবার ও অন্যান্য ত্রাণ পেয়ে থাকি৷ক্যাম্পের অধিকাংশ বাসিন্দারই কোনো কাজ নেই৷ যেমন হাসিনার বাবা এনায়েতুল্লাহর বয়স ৪৪৷ ঘরের জন্য একপাত্র পানি নিয়ে এসেছেন তিনি৷ রাখাইনে ফেলে আসা বাড়িঘরের কথা স্মরণ করে এনায়েতুল্লাহ বলেন, আমার অনেক ফসলি জমি ছিল৷ আমি সেখানে চাষাবাদ করতাম৷ গোয়ালে গরু ছিল, নিজেদের ঘর ছিল, আরো অনেক কিছুই ছিল৷ আমরা সবকিছুই ফেলে এসেছি৷তিনি জানান, স্ত্রীকে নিয়ে পালিয়ে এসেছেন বাংলাদেশে৷ নিজেদের সম্পদের কথা ভাবার সময় পাননি৷ জানালেন, পাঁচ বছর পর নিজের ভিটেবাড়ির কথা খুব মনে পড়ে তার৷এনায়েতুল্লাহর মতো ক্যাম্পের অনেকেই কাজ করে উপার্জন করতে চান৷ যেমন ক্যাম্পের আরেক বাসিন্দা মোহাম্মদ শাফি জানালেন, আমরা ক্যাম্পের বাইরে যেতে পারি না৷ মাঝে মাঝে বাইরে কাজের ডাক পাই৷ কিন্তু এমন সুযোগ খুব কম৷বছরের পর বছর ধরে আটকে থাকা এই ক্যাম্পে শুধু চলাফেরাই সীমিত নয়, রোহিঙ্গা শিশুদের পড়াশোনার সুযোগও ক্যাম্পে খুব কম৷ দশম শ্রেণিতে পড়ুয়া মোহাম্মদ রিয়াজ জানাল, এটাই তার শেষ ক্লাস৷ কারণ,ক্যাম্পের ভেতরে এর বেশি পড়াশোনার সুযোগ নেই৷ এই বছরের পর আমার আর পড়াশোনার সুযোগ নেই৷ কিন্তু আমি পড়তে চাই৷ নানা সময়ে রোহিঙ্গারাও অবশ্য তাদের দাবি-দাওয়া আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের কাছে তুলে ধরার চেষ্টা করেছে৷ কিছুদিন আগে জাতিসংঘের মানবাধিকার কমিশনার মিশেল বাশেলেট ক্যাম্প পরিদর্শনে গেলে রোহিঙ্গারা জানান, তারা কাজ করে উপার্জন করতে চান এবং নিজেদের জীবন গড়ে তুলতে চান৷এদিকে এমন সব সীমাবদ্ধতা এড়িয়ে উন্নত জীবন গড়ার আশায় অনেক রোহিঙ্গাই ক্যাম্প থেকে পালিয়ে পার্শ্ববর্তী দেশগুলোতে আশ্রয়ের চেষ্টা করেন৷ কিন্তু এমন চেষ্টায় সমস্যার সমাধান তো কমেই না বরং তা আরো বেড়ে যায়৷আন্তর্জাতিক মানবাধিকার সংস্থা হিউম্যান রাউটস ওয়াচ- এশিয়ার পরিচালক এলাইনে পিয়ারসন বলেন, রোহিঙ্গারা যেন স্বাধীন জীবন গড়ে তুলতে পড়াশোনা এবং কাজের সুযোগ পায় সেজন্য আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের এগিয়ে আসা উচিত৷ বছরের পর বছর ধরে কক্সবাজারের অস্থায়ী শিবিরে অনিশ্চয়তায় দিন গুনছে দেশ ছেড়ে আসা এই মানুষগুলো৷ তবে অনিশ্চয়তা যতই থাকুক, দেশের ফেরার অদম্য ইচ্ছা আর প্রত্যয় ভিটেমাটিহারা এ মানুষগুলোর৷ ফিরে পেতে চান নিজেদের ফেলে আসা ঘর আর মাটি৷এনায়েতুল্লাহ বলেন,আমি জানি না কবে পারব,তবে একদিন আমি দেশে ফিরে যেতে চাই৷ রোহিঙ্গা নারী তাসমিদা বেগম বলেন,দেশের কথা মনে হলে আমার মন কেঁদে উঠে৷ আমাদের সম্পদ ফেরত দিলে এবং আমাদের শান্তিতে থাকতে দিলেই আমরা দেশে যাব৷২০১৭ সালে সেনাবাহিনীর হাতে প্রাণ হারায় তাসমিদার নিজের ভাই ও তার স্বামীর ভাই৷ নির্যাতনের সেই স্মৃতি এখনো বয়ে বেড়ান তাসমিদা৷ তার ভয়,দেশে ফিরে গেলে মিয়ানমারের সেনারা তাদের ওপর আবারও নির্যাতন চালাবে৷ অবশ্য বাংলাদেশে আশ্রয় নেওয়া এই রোহিঙ্গারা এখন পর্যন্ত দেশে ফিরতে না পারার পেছনে সরকারের অনিচ্ছাকেই দায়ী করছেন মিয়ানমারের ন্যাশনাল ইউনিটি গভর্নমেন্টের পরামর্শক আউং ক্যা মো৷তিনি বলেন, সরকারের ইচ্ছা না থাকায় রোহিঙ্গাদের প্রত্যাবাসন শুরু হচ্ছে না৷ সরকার চায় না রোহিঙ্গারা ফিরে যাক৷ উল্লেখ্য আউং ক্যা মো হলেন মিয়ানমার সরকারে জায়গা পাওয়া প্রথম রোহিঙ্গা প্রতিনিধি৷রোহিঙ্গারা বাংলাদেশে আসার পর থেকেই মিয়ানমার, বাংলাদেশ এবং জাতিসংঘের মধ্যে প্রত্যাবাসন বিষয়ে আলোচনা চলছে৷ প্রত্যাবাসন বিষয়ে রোহিঙ্গাদের তালিকা করতে একটি জয়েন্ট টাস্কফোর্সও গঠন করা হয়েছে৷রোহিঙ্গা প্রত্যাবাসন বিষয়ে বাংলাদেশ সরকারের কর্মকর্তা মোহাম্মদ শামসুদ দোজা বলেন, প্রত্যাবাসনের জন্য আমরা ইতিমধ্যে আট লাখ ৩০ হাজার রোহিঙ্গার একটি তালিকা দিয়েছি৷ তারা (মিয়ানমার সরকার) এটি গ্রহণও করেছে৷ আমরা রোহিঙ্গাদের মানবিক সহায়তা দিচ্ছি৷ একসময় তাদেরকে ফিরে যেতে হবে৷ বাংলাদেশ সরকার অবশ্য রোহিঙ্গাদের মিয়ানমারে ফেরত পাঠানোর বিষয়ে আশাবাদী৷ সম্প্রতি বাংলাদেশের পররাষ্ট্রমন্ত্রী আশা প্রকাশ করেন, চলতি বছরের শেষ নাগাদ রোহিঙ্গাদের প্রত্যাবাসন প্রক্রিয়া শুরু হতে পারে৷তবে প্রত্যাবাসন বিষয়ে মো-এর ভাবনা অবশ্য ভিন্ন৷ তার মতে রোহিঙ্গাদের তালিকা তৈরির বিষয়টি মূলত প্রক্রিয়াটিকে দীর্ঘায়িত করার একটি কৌশল৷ মিয়ানমার সরকারের কাছে তালিকাটি আছে৷ সরকার ভালভাবেই জানে কে দেশ ছেড়েছে৷ তিনি বলেন,যদি সত্যি প্রত্যাবাসন প্রক্রিয়া শুরু করতে চায় তাহলে মিয়ানমার সরকার বাংলাদেশের কাছে বলতে পারত যে, এই হলো রোহিঙ্গাদের একটি তালিকা যারা মিয়ানমারের ‘এ’ (উদাহরণ হিসেবে) গ্রামের,তাদের খুঁজে বের করে দেশে ফেরত পাঠানো হোক৷রোহিঙ্গাদের উপর নির্যাতন চালানোর জন্য এখনো পর্যন্ত কেউ দোষী সাব্যস্ত হয়নি৷ আন্তর্জাতিক অপরাধ আদালতে আফ্রিকার দেশ গাম্বিয়া একটি মামলা দায়ের করেছে৷ মামলার শুনানি চলছে৷আন্তর্জাতিক মানবাধিকার সংস্থাগুলো অবশ্য জাতিসংঘের নিরাপত্তা পরিষদকে মিয়ানমারের উপর অস্ত্র নিষেধাজ্ঞা প্রস্তাব আনার দাবি জানাচ্ছে।এদিকে মানবাধিকার সংস্থা হিউম্যান রাইটস ওয়াচ মিয়ানমারের সামরিক বাহিনীর উপর সুনির্দিষ্ট নিষেধাজ্ঞা আরোপের দাবি জানাচ্ছে৷ এ বিষয়ে মিয়ানমারে সরকারের উপদেষ্টা মো বলেন, রোহিঙ্গাদের জন্য চীন সবসময়ই একটি সমস্যা৷ নিরাপত্তা পরিষদে চীন ও রাশিয়া যে বাধা তৈরি করছে তা মোকাবেলায় আমাদের নতুন কৌশল গ্রহণ করতে হবে৷তবে রোহিঙ্গা নারী হাসিনা বলেন, ন্যায়বিচার বিষয়টি কেমন তিনি জানেন না৷ সেনা নির্যাতনের কারনে যে শারীরিক ও মানসিক কষ্ট তার হচ্ছে এই পরিস্থিতিতে উন্নত জীবন তো দূরে থাক স্বাভাবিক জীবনে ফিরে আসাই তার কাছে বহু দূরের পথ৷ হাসিনা বলেন, আমি জানি না এরপর কী হবে৷ এখানে (বাংলাদেশে) বা অন্য কোথাও আমি কোনো ভবিষ্যৎ দেখি না৷ সৌজন্যে : ডয়চে ভেলে