অনলাইন ডেস্ক ০৫ সেপ্টেম্বর ২০২২, ২০:০০

মিয়ানমারে বাংলাদেশ ও ভারত সীমান্ত-সংলগ্ন এলাকায় রাখাইন রাজ্যে গত কিছুদিন ধরে অব্যাহত সংঘর্ষ চলছে, যার প্রভাব পড়ছে প্রতিবেশী দেশগুলোর ওপরেও। বিশেষ করে বান্দরবানের ঘুমধুম ও তমব্রু সীমান্ত এলাকার বাসিন্দারা আতঙ্কের মধ্যে রয়েছেন। অন্যদিকে এসব রাজ্যের অনেক মানুষ পালিয়ে ভারতে আশ্রয় নিয়েছেন।

আগস্ট মাসে বাংলাদেশের এলাকায় গোলা পড়ার কারণে মিয়ানমারের রাষ্ট্রদূতকে ডেকে সতর্ক করেছে বাংলাদেশ। রোববারও মিয়ানমারের রাষ্ট্রদূতকে ডেকে কড়া প্রতিবাদ জানিয়েছে বাংলাদেশ।

সীমান্ত-সংলগ্ন এলাকায় যেকোনো ধরনের গোলার ব্যবহার করার আগে প্রতিবেশী দেশের সাথে তথ্য আদান-প্রদানের রীতি রয়েছে। কিন্তু বাংলাদেশ সীমান্তে এসব গোলাগুলির ঘটনা ঘটলেও বাংলাদেশের সাথে কোনোরকম তথ্য আদান-প্রদান করা হয়নি বলে কর্মকর্তারা জানান।

বাংলাদেশের পররাষ্ট্র প্রতিমন্ত্রী শাহরিয়ার আলম বেসরকারি টেলিভিশন একাত্তরকে দেয়া একটি সাক্ষাৎকারে বলেন, ‘মিয়ানমারে সংঘর্ষের ঘটনায় বিজিবি ও অন্যান্য বাহিনীকে সর্বোচ্চ সতর্কাবস্থায় রাখা হয়েছে, যেন কোনো ধরনের অনুপ্রবেশ যাতে না ঘটে, সেটা রোহিঙ্গা হোক, তাদের বিদ্রোহী বাহিনীর হোক অথবা মিয়ানমার সেনাবাহিনীর হোক- সেটা আমরা বরদাস্ত করব না। আমরা আর কোনো রোহিঙ্গাকে নিতেও প্রস্তুত নই।’

সামরিক শাসনে থাকা মিয়ানমারে কড়া সেন্সরশিপ থাকায় সেদেশের কোনো তথ্য পাওয়া বেশ কঠিন।

তবে পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়, বিজিবি, বান্দরবানের স্থানীয় বাসিন্দা এবং মিয়ানমারের সংবাদপত্র থেকে পাওয়া তথ্যে জানা যাচ্ছে, আগস্ট মাসের শুরু থেকে ওই দেশের রাখাইন, তানপট্টি ও হাকা রাজ্যে মিয়ানমার সেনাবাহিনীর সাথে আরাকান বিদ্রোহী বাহিনীগুলোর লড়াই চলছে।

একদিকে যেমন রাখাইনে আরাকান আর্মির সাথে মিয়ানমারের সেনাবাহিনীর লড়াই চলছে- অন্যদিকে গত মে মাস থেকে কায়াহ, কাইন ও চিন রাজ্যেও বিদ্রোহী গোষ্ঠীগুলোর বিরুদ্ধে বড় ধরনের সামরিক অভিযান শুরু করে মিয়ানমারের সেনাবাহিনী। ওই যুদ্ধে হেলিকপ্টার, যুদ্ধবিমানও ব্যবহার করছে সেদেশের সামরিক বাহিনী।

থাইল্যান্ড ভিত্তিক মিয়ানমারের দৈনিক ইরাবতির খবর অনুযায়ী, রোববার মংডুতে আরাকান আর্মির (এএ) হামলায় সীমান্ত রক্ষী পুলিশের অন্তত ১৯ জন নিহত হয়। তারা ওই স্টেশনের অস্ত্র ও গোলাবারুদ লুট করে।

এরপর মিয়ানমারের সেনাবাহিনী যুদ্ধবিমান এবং হেলিকপ্টার নিয়ে বিমান হামলা শুরু করে। রাখাইন রাজ্যের একাধিক স্থানে এসব বিমান ও হেলিকপ্টার থেকে গোলাবারুদ ও ক্ষেপণাস্ত্র ছোঁড়া হয়। এর আগে থেকেই গত একমাস ধরে আরাকান আর্মির সঙ্গে মিয়ানমারের সেনাবাহিনীর লড়াই চলছিল।

ঘুমধুম ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান এ কে এম জাহাঙ্গীর আজিজ বিবিসি বাংলাকে জানিয়েছেন, সেখানে গত এক মাস ধরেই প্রতিদিন সীমান্তের ওপার থেকে গোলাগুলির আওয়াজ আসছে। গত কয়েকদিন ধরে যুদ্ধবিমান আর হেলিকপ্টার থেকে গোলা ছুঁড়তে দেখা গেছে।

স্থানীয় বাসিন্দাদের কাছ থেকে তিনি তথ্য পেয়েছেন, মিয়ানমারের ভেতরে আরাকান বাহিনীর সাথে সেনাবাহিনীর তুমুল লড়াই চলছে। সেনাবাহিনী একের পর এক গ্রামে অভিযান চালাচ্ছে। অনেক গ্রামে ঘরবাড়ি পুড়িয়ে দিয়েছে।

যুক্তরাষ্ট্রের ইন্সটিটিউট অফ পিসের তথ্য অনুসারে, মিয়ানমারে সামরিক অভ্যুত্থানের আগে ২০২০ সালে আরাকান আর্মির সাথে সেদেশের সেনাবাহিনীর যুদ্ধবিরতি সমঝোতা হয়েছিল। কিন্তু অভ্যুত্থানের পর দেশের অন্যান্য স্থানের মতো রাখাইন রাজ্যেও সেনাবাহিনী বিরোধী মনোভাব বেড়ে ওঠে। এরই সুযোগে আরাকান আর্মি ওই যুদ্ধবিরতি থেকে বের হয়ে আবার নিজেদের শক্ত অবস্থান তৈরির উদ্যোগ নিয়েছে।

কিন্তু ২০২৩ সালের আগস্ট মাসে মিয়ানমারে সাধারণ নির্বাচনের আয়োজন করতে চায় সামরিক জান্তা। এর আগে তারা রাখাইন ও অন্যান্য রাজ্যে নিজেদের পুরোপুরি নিয়ন্ত্রণ প্রতিষ্ঠা করতে চাইছে। রাখাইন রাজ্য তাদের জন্য বিশেষভাবে গুরুত্বপূর্ণ, কারণ এ রাজ্যের সাথে বাংলাদেশ ও ভারতের সীমান্ত রয়েছে, বলছে ইন্সটিটিউট অফ পিস।

দৈনিক ইরাবতি বলছে, ২ আগস্ট থেকে আরাকান আর্মি একাধিক জায়গায় সেনাবাহিনী ও পুলিশের ওপর হামলা শুরু করে। এর পাল্টা জবাব হিসেবে অভিযান শুরু করে মিয়ানমারের সেনাবাহিনী।হেলিকপ্টার ও বিমান হামলার পাশাপাশি সেখানকার ছয়টি সেনা চৌকি থেকে প্রতিদিন ৩০০ থেকে ৪০০ শেল ছোঁড়া হচ্ছে বলে ইরাবতি জানায়।

দৈনিক ইরাবতি খবর দিয়েছে, মেয়িক ওয়া গ্রামে গত বুধবার হামলা চালিয়ে ১০ সৈন্য হত্যা করে আরাকান বাহিনী। রাখাইনের গণমাধ্যম জানিয়েছে বৃহস্পতিবার দুপুরের পর রাখাইন রাজ্যের আন শহরতলীতে একটি সেবা বহরে অতর্কিত হামলা করে আরাকান আর্মি। সেখানে বেশ কয়েকজন হতাহত হয়। ভিডিও ফুটেজে দেখা গেছে, সড়কের ওপর সামরিক বাহিনীর গাড়িতে আগুন জ্বলছে।

আরাকান আর্মি তাদের এসব হামলা শুরু করেছে এমন সময়, যার কিছু দিন আগে থেকেই মিয়ানমারের কয়েকটি রাজ্যে বিদ্রোহী বাহিনীর হামলার মুখে পড়েছে সেনাবাহিনী।

বিশেষ করে সাগাইং ও ম্যাগওয়া অঞ্চলে জান্তা বিরোধী পিপলস ডিফেন্স ফোসের্স (পিডিএফ) সেনাবাহিনীর সাথে তীব্র লড়াই শুরু করেছে।চিন স্টেটে অন্তত দুটি বিদ্রোহী গোষ্ঠী- চিন ডিফেন্স ফোর্স ও চিন ন্যাশনাল আর্মি সে দেশের সেনা ও প্রশাসনের বিরুদ্ধে সশস্ত্র আন্দোলন চালাচ্ছে বহু দিন ধরেই।

ইরাবতির খবরে বলা হয়েছে, কায়াহ রাজ্যে গত মে মাস থেকে সেনাবাহিনীর সাথে লড়াই করে যাচ্ছে বিদ্রোহী কারেনি ন্যাশনালিটিজ ডিফেন্স ফোর্স, দ্যা কারেনি আর্মিসহ কয়েকটি বিদ্রোহী গোষ্ঠী। পাশের শান রাজ্যেও সেনাবাহিনীর বিরুদ্ধে লড়াই করছে কয়েকটি বিদ্রোহী গোষ্ঠী।

বিদ্রোহীদের দাবি, এ পর্যন্ত তারা দেড় হাজার সৈন্যকে হত্যা করেছে- যদিও এই তথ্য নিরপেক্ষভাবে যাচাই করা সম্ভব হয়নি।গত বছর থেকে সে দেশের গণতন্ত্রকামীরাও আর্মির বিরুদ্ধে নিয়মিত বিক্ষোভ দেখাচ্ছে, সামরিক শাসনের বিরুদ্ধে প্রতিবাদ জানাচ্ছে। সেই সাথেই পাল্লা দিয়ে বাড়ছে সেনাবাহিনীর ক্র্যাকডাউন ও নির্যাতন।

এসব বিদ্রোহ দমনে তীব্র গোলাগুলি, মর্টার ছাড়াও বিমান ও ভারী কামানের গোলা ব্যবহার করছে মিয়ানমারের সেনাবাহিনী। তারা সেখানকার একাধিক গ্রাম পুড়িয়ে দিয়েছে এবং গ্রামে গ্রামে অভিযান চালাচ্ছে। ফলে এসব এলাকা থেকে বহু মানুষ ভারতের মিজোরামে গিয়ে আশ্রয় নিয়েছেন।

মিয়ানমারের রাখাইন রাজ্যটি বাংলাদেশের সীমান্ত-সংলগ্ন একটি এলাকা। যেখানে সংঘর্ষ চলছে, সেটিও বাংলাদেশের সীমান্তের ঠিক ওপারে। ফলে সেখানকার সংঘর্ষে আতঙ্কিত হয়ে পড়েছেন সীমান্ত এলাকার বাংলাদেশি বাসিন্দারা।

ঘুমধুম ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান এ কে এম জাহাঙ্গীর আজিজ বলেন, সীমান্তের কাছাকাছি অনেক গ্রাম আছে। গোলাগুলির শব্দে কেউ বাড়িতে থাকতে নিরাপদ বোধ করছে না।গত ২৮ আগস্ট রোববার দুপুর আড়াইটার দিকে বান্দরবান জেলার নাইক্ষংছড়ির তমব্রু উত্তর পাড়ার কাছে মিয়ানমার থেকে ছোঁড়া দুটি মর্টার শেল এসে পড়ে বলে স্থানীয় প্রশাসন জানায়। তবে এতে কোনো হতাহতের ঘটনা ঘটেনি।

এরপর ২ সেপ্টেম্বর সকালে সীমান্তের কাছে মিয়ানমারের যুদ্ধবিমান ও হেলিকপ্টার থেকে গোলা ছোঁড়া হলে বাংলাদেশ সীমান্তের ১৫০ মিটার ভেতরে পড়ে বলে স্থানীয় বাসিন্দারা জানিয়েছেন।

যেখানে এই সহিংসতা চলছে, সেই নাইক্ষৎছড়ির তমব্রু সীমান্ত রেখায় সাড়ে চার হাজার রোহিঙ্গা গত কয়েক বছর ধরে বসবাস করছে। সহিংসতার কারণে তারা বাংলাদেশের ভেতরে চলে আসার আশঙ্কা তৈরি হয়েছে।তবে বাংলাদেশের পররাষ্ট্র প্রতিমন্ত্রী শাহরিয়ার আলম বলেন, বাংলাদেশ আর কোনো রোহিঙ্গা গ্রহণ করবে না।

বাংলাদেশ বর্ডার গার্ড বিজিবির পরিচালক (অপারেশন্স) লেফটেন্যান্ট কর্নেল ফয়জুর রহমান বলন, মিয়ানমারে সংঘর্ষের ঘটনায় বিজিবি সতর্ক অবস্থানে রয়েছে। বাংলাদেশের ভেতরে যাতে কেউ প্রবেশ করতে না পারে, সেজন্যও তারা সতর্ক রয়েছেন।

নিরাপত্তা বিশ্লেষক ও বাংলাদেশ সেনাবাহিনীর অবসরপ্রাপ্ত বিগ্রেডিয়ার জেনারেল সাখাওয়াত হোসেন মনে করেন, সীমান্তের ওপারে সংঘর্ষ হলেও এ নিয়ে বাংলাদেশের উদ্বেগের যথেষ্ট কারণ রয়েছে।

তিনি বলেন, ‘যে জায়গায় সংঘর্ষ হচ্ছে বলে বলা হচ্ছে, সেটা আমি ভালো করে চিনি। সেখানে চলাচল বেশ কঠিন। এরকম গোলাগুলি হতে থাকলে, সীমান্তের তাহলে বাংলাদেশের জন্য একটি বড় উদ্বেগের বিষয়। বিশেষ করে এমন এলাকায়, যেখানে প্রবেশ বা চলাচল করা কঠিন। আমি যতদূর জানি, আরাকান আর্মির সাথে একসময় মিয়ানমারের সেনাবাহিনীর বোঝাপড়া থাকলেও এখন তারা মিয়ানমার আর্মির ওপর বিভিন্ন জায়গায় হামলা করছে, সেটার কারণে এই পরিস্থিতি তৈরি হয়েছে। ফলে সেখানকার বিদ্রোহীরা বা স্থানীয় লোকজন সীমান্ত টপকে ভেতরে চলে আসতে পারে। সেখানে পেট্রলিং করা বেশ কঠিন।’

তিনি বলেন, ‘সাধারণত সীমান্তের কাছে কোনো অভিযান চালানো হলে, এ অপারেশন হলে দুটি রাষ্ট্রের মধ্যে সম্পর্ক থাকলে একটা ওয়ার্নিং দেয়া হয়। কিন্তু এরকম কোনো তথ্য বাংলাদেশকে জানানো হয়নি। আরাকান বিরুদ্ধে তাদের অভিযান চালালেও সীমান্ত এলাকায় অভিযান চালানোর আগে বাংলাদেশকে না জানানো আন্তর্জাতিক রীতিনীতির একটি লঙ্ঘন।’

সূত্র : বিবিসি

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *